শানপুর ওভার ব্রিজের ওপর দক্ষিণমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাতেন ভাই। পাশ দিয়ে হাজারো মানুষ চলাচল করছে। কেউ জানতে চাচ্ছে না, সে এখানে এতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কেন? এই শহরটা বড় নিষ্ঠুর, আরও নিষ্ঠুর শহরের মানুষগুলো। রাতের ড্রিম লাইটের আলোর মত মানুষগুলোর মনও ফেকাশে হয়ে গেছে। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। মায়া দয়া বিহীন মানুষের ভীড়ে একজন মানুষ ওভার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে কী চিন্তা করছে, তা কারোর দেখার কথা নয়।
আকাশে মেঘের কোন ছায়াও নেই। অথচ হঠাৎ করেই ক-পশলা বৃষ্টি নেমে গেল। পথের ধূলি বাতাসে উড়ে পরিবেশটাকে একবারে জগা-খিচুড়ি করেছিল। পথে চলতে গেলে নাকে মুখে আলাদা কাপড়ের টুকরো চেপে ধরতে হয়। কখনো আবার দিনের বেলায় দাউ দাউ আগুনের ফুলকির মত রোদ ওঠে। এই রোদের মধ্যে বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষেরা ছুঁটেছে তাদের নিজেদের কাজে।
ভোর থেকে ছুঁটে চলছে কম বয়সের অনেক হকাররা। এক গাদা পত্রিকার বান্ডেল নিয়ে এক গাড়ি থেকে আরেক গাড়িতে। অথচ ওই পত্রিকার ওজনের সমানও ছেলেগুলোর ওজন হবে না। জীবনের তাগিদে সবাই ছুঁটছে এক জায়গা থেকে অন্যত্র।
শানপুর, রাজধানি মতিহারের এক মাত্র বাটপাইয়া এলাকা। এখানে ঘটেনা এমন কোন কাজ নেই। চুরি ডাকাতি ছিনতাই পকেটমার মলমপার্টি থেকে শুরু করে নারী বিষয়ক কাজ। অথচ এখানেই দেশের সব চেয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। আছে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, কারিগরি প্রশিক্ষণ ভিক্তিক বিভিন্ন কলেজ। একদিন এখানের কোন অফিস বন্ধ থাকলে দেশের জন্য অশূভ হয়। এখানে আছে রাজধানির সব চেয়ে বড় কাঁচা বাজার। আছে হোটেল, রেষ্টুরেন্ট, আবাসিক এলাকা।
এই ব্রিজের ওপর থেকে বাটপাররা মানুষদেরকে টার্গেট করে, কাজ হাছিল করে। কোন লোকেগুলো রাজধানিতে পুরানো ও নতুন আমদানি। ওদের মূল টার্গেট থাকে গ্রাম থেকে আসা লোকদের ওপর। পথে হাঁটার ভাব দেখেই ওরা গ্রামের লোকদেরকে চিনতে পারে।
বাতেন ভাইও গ্রামের সন্তান। সেই বারো বছর আগে এই শহরে সে এসেছে। কোন এক কাক ডাকা ভোরে বাতেনের শানপুরে পা রাখা। প্রথমেই সে হোঁচট খায়। দূর পাল্লার গাড়িতে করে বাতেন নেমেই একটু প্রকৃতির টানে কাজ সেরে পেছন ফিরে দেখে তার ব্যাগটা নেই। বাতেন হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে। ওখানে তেমন বেশী টাকা পয়সা না থাকলেও দামি জিনিস ছিল।
বাতেন ব্যাগ রাখা ওই জায়গাটাতে অপলক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ধরে তাঁকিয়ে থাকে। বেলা বাড়তে থাকে। বাতেন সেখানে থেকে সরে না। ভাবে, কেউ যদি ভুলে নিয়ে থেকে আবার ফেরত দিতে আসে, সেই আশায়। শানপুরে পাওয়া বলতে কোন হিসেব নেই, শূধু হারানোর পালা।
অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাতেন এই শহরে আসে। বাবা-মা হীন এক মাত্র বোনকে বিয়ে দেওয়ার জন্য টাকা কামাই করতে হবে। বাতেন ব্যাগের আশা বাদ দিয়ে দু-হাত দিয়ে চোখ ঘসে চারদিকে তাঁকিয়ে অবশেষে ওপরে তাঁকিয়ে কি যেন ভাবে। বিদুৎ এর তারের ওপর সকাল সকাল কাকের মেলা বসেছে। একটা বাদুরের দেহ তারের সাথে লেগে থাকতে দেখা গেল। বাদুর চোখে দেখে না। কিন্তু কানে শুনার ক্ষমতা তুখোড়। অতি ক্ষুদ্র শব্দও শুনতে পারে। বাদুর শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে চলার পথের দিক নির্ধারন করে পথ চলে। হঠাৎ করেই একটা কাকের পাছার মাল বাতেনের কাঁধে পড়ে। বাম হাত দিয়ে নাকে নেওয়ার আগেই ঘটনা বুঝতে পারে।
পেটে বাতেনের ক্ষুধা। এমন সময় এই কাজ কাকের ! বাতেন রাগে বলল, শালার কাকের বাচ্চা কাক আর বুঝি জায়গা পেলিনা ! কয়েকজন কাগজ কুড়ানো পোলাপান ওর পাশ দিয়ে পেছনে ছেঁড়া ছালা নিয়ে যাচ্ছে আর বলছে, "আজ হিসেবের খাতায় ভাগটা ভালোই পাবো রে, তাই না?"
আরেকজন বলছে, "ঠিক তাই। সু-সময় সব সময় আসেনা। কিন্তু ওই লোকের জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছে রে। কি সুন্দর সার্ট ও প্যান্ট পড়া ছিল, তার পেটে মেরে দিলাম ছোরা, পেয়ে গেলাম লাখখানি টাকা। লোকটা মনে হয় শানপুর এসেছিল কোন চাকরির খুঁজে ঘুস দিতে। তাছাড়া মনে হয়না তিনি এখানের স'ায়ী বাসিন্দা।"
বাতেন, বাম হাতে লাগা কাকের মাল একটা দেয়ালে মুছে ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। কাছে কোন জলের ব্যবস্থা না থাকায় দেয়ালে মোছা। সৃর্যের তাপটা বেড়ে যাচ্ছে, সাথে পেটের ক্ষুধা। খাবার হোটেলে ভিড়। বেশীর ভাগ লোকেরই নাস্তার উপকরণ রুনটি ও ভাজি। কেউবা সাথে ডিমের ওমলেট।
কাগজ কুড়ানো ছেলেদের দিকে আর নজর না রেখে বাতেন এক হোটেলের কাছে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। পকেটে কোন টাকা নেই। যে ক’টা ছিল তা ব্যাগে ছিল। হোটেলের ক্যাশিয়ার বাতেনের কাছে তার চাচার মত দেখতে। মাথার সামনে কোন চুল নেই, নাকটা লম্বাটে দেহটা মধ্যম ধাচের। একের পর এক লোকজন খেয়ে যাচ্ছে। অনেকেরই খেয়েও কিছু ফেলে যাচ্ছে, সেগুলোও যদি বাতেন খেতে পারে ক্ষুধা থাকবে না। তবে বাতেন ওগুলো খাবেনা। সে তো ফুটপাতের টোকাই না। ব্যাগটা চুরি হওয়ার কারণে বাড়ি থেকে আনা খাবার...।
বাতেনের জিহ্বা্ দিয়ে জল পড়ছে। ক্ষুধার কারণে চোখে মুখের জল শুকিয়ে গেছে। করুণ দৃষ্টিতে ক্যাশিয়ারে দিকে তাঁকিয়ে আছে সে, যাতে তিনি ওর দিকে তাঁকায় কিনা দেখতে। একটা পাঁচশত টাকা নোট আলোতে নিয়ে দেখতে গিয়েই ক্যাশিয়ারে নজরে পড়ে বাতেন। বলে, এই ছোকরা, ওমন কুকুরের মত হা করে আছিন কেন? এই টাকা ছিনিয়ে নিবি নাাকি?
বাতেন মাথা নাড়ে, "না।"
বলতে চায়, "একটা রুটি...!"
ক্যাশিয়ার তাঁদের লোকগুলোকে বলল, ধর এই ছিনতাইকারিকে। আমার পাঁচশত টাকা ছিনতাই করতে চাচ্ছে।
বাতেন তখনও বলছে, "না, না। শুধু একটা রুটি... চাচা?"
লোকগুরো তেড়ে আসতেই ক্যাশিয়ার তাদেরকে হাত দিয়ে আঁটকে বলল, "কে তোর চাচা? আমার তো কোন নিদিষ্ট মা বাপই নেই। কার গর্ভে জন্ম তাই তো জানিনা। তুই আবার ভাতিজা হলি কবে? শালার বেটা আমাকে ভুলাতে চাচ্ছিস না? এ খাড়া দেখাচ্ছি মজা।"
বাতেন তখনও বলে যাচ্ছে, "একটা রুটি..., চাচা?"
বাতেন যখন নিজেকে সৃষ্টি করল তখন সে একটা ময়লার স্তূপের কাছে পড়ে আছে । নাকে যেন হঠাৎ করেই গন্ধ ঢুকলো। অচেতন থাকলে নাকে গন্ধ যায় না ! পঁচা সবজির গন্ধ, ডিমেরর গন্ধ, ফুটপাতে বড় হওয়া মানুষের গুয়ের গন্ধ, পথ দিয়ে হাঁটা সবার পেচ্ছাবের গন্ধ। বাড়ি থেকে পড়ে আসা বোনের ধোয়া দেওয়া সার্ট প্যান্টের অবস্থা আর আগের মত নেই।
বাতেনের চোখ দিয়ে টপাটপ জল পড়ছে। যে আশা নিয়ে সে এই শহরে এসেছে তার যে কতটা পূরণ করতে পারবে তা ভেবে বাতেন আরও কাঁদতে থাকে। যে করেই হোক সাফল্য তাকে পেতেই হবে। একমাত্র বড় বোনকে বাতেন বিয়ে না দিয়ে বুড়ো হতে দিতে পারে না। বাতেনের চোখের সামনে ভাসছে, তার বোন বিয়ের আসরে বসে আসে। সাথে বোন জামাই। বাতেন আজ মহাখুশি। জীবনের একটা শ্রেষ্ট চাওয়া পূরণ হল। তাই স্রষ্টার দরবারে দোয়া করছে।
হঠাৎ কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ে বাতেনের ধ্যান ভেঙে যায়।। ওরা এখন ওই ময়লা থেকে খাবার বের করে খাবে তাই কাছে অন্য জাতির উপস্থিতি কামনা করছে না। সাদা কালো নীলসহ পাঁচ সাতটা কুকুর বাতেনের দিকে তঁকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে শালার মানুষ তোরাও এখন আমাদের খাবারে ভাগ বসিয়েছিস? একটা কুকুর তার লেজ ঘুরিয়ে তেজী ভাব দেখাচ্ছে। মনে হয় বাতেনের উপর হামলা করবে খাবারে ভাগ বসানোর অপরাধে।
বাতেন আর কিছু না ভেবে অন্য দিকে চলে গেল। এই শহরে কেউ তার আপন বলতে নেই। ঠিক ক্ষুধার সময় যদি খাওয়া না যায় তবে পরে আর তা থাকে না। বাতেনের অবস্থা হয়েছে তেমন। ইহা আর কতক্ষণ থাকবে ! খেতে তো হবেই। বাতেন ভাবছে, টাকা কামাই করি আর নাই করি আগে নিজের জীবন বাঁচাতে হবে। জীবনই যদি না বাঁচে তবে টাকা কামাই করে বোনকে বিয়ে দেওয়া হবে না। এভাবে না খেয়ে মরা যাবেনা। কিন্তু কী করা যায় ! যাই করতে যাই না কেন তার জন্য পুঁজির দরকার। তা কোখায পাবো ! না পাওয়ার আশাই বেশী। করতে হবে চুরি, করতে হবে ডাকাতি, করতে হবে ছিনতাই। জীবনের ছিনতাই্ করিনি, ছিনতাই না করেই গণ পিটুনি খেয়ে ময়লার ওপর এক রাত থাকতে হয়েছে আমাকে। তাহলে সেই ছিনতাইকারিই হবো আমি। এলাকার সেরা ছিনতাইকারি, সেরা বাটপার, সেরা সন্ত্রাসী।
নিজের মাঝে নিজেকে তেজী ভাব দেখাতে গিয়েও পেলো না বাতেন। একটা কিছু দিয়ে পেটটা ভরানো চাই। কি খাবো, মানুষ হয়ে তো ঘাস গোবর লতা পাতা খেতে পারিনা !
সন্ধা হয়ে আসছে দুপুরে একটা অর্ধ খাওয়া রুটি জোটেছিল। একটা মেয়ে খাইতেছিল, তা চাইতেই মেয়েটা দিযে দেয়। মায়াহীন মানুষের ভিড়ের ক’জন মায়ার মানুষ এই দুনিয়ায় এই শহরে আছে। ওই তো এক অর্ধ বুড়ো লোক হাতে করে কি যেন নিয়ে যাচ্ছে। খাওয়ার জিনিসই হবে মনে হচ্ছে। ডান পাশে একটা গলি আছে, ছিনতাই করে ওদিকে দৌড় দিবে বাতেন ভাবছে। আর ওই বুড়োর কাছ থেকে জিনিস নিতে আবার দৌড় দিতে হবে ! একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে ।
বুড়ো একটা হালকা চিৎকার করলেন। ক’জন মানুষ আসতে চেয়েও এলোনা। এই শহরে সবাই নিজের জন্য ব্যাস্ত। কোথায় কে ছোরার আঘাত খেলো না খেলো তা নিয়ে কারোর মাথা ব্যাথা নেই। না ! বুড়ো তাঁর পুটলায় ভালোই কিছু রেখেছেন। সবই খাবার জিনিস। একটা ছোট বাক্সের ভিতরে কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে। কয়েকটা বাঁধ দেওয়া তাতে। বাতেন তা খুলে দেখল। একটা কাঠের তৈরি পুতুল। হয়তো বুড়ো তাঁর ছোট কোন নাতি নাতনিকে দিতে কিনেছিল।
বাতেনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছিনতাইকারিদের মন তো খারাপ হওয়ার কথা নয়। ক্ষণিকেই মনটা ছোট বাচ্চাদের মত হয়ে গেল। যা-ই হোক, বাতেন খেয়ে পেটটা ঠান্ডা করে নিল। আজ রাত থেকেই বাতেন তার মূল পরিকল্পনায় কাজ শুরু করবে। কী দিয়ে শুরম্ন করা যায় তাই ভাবে।
দুদিনে হয়ে গেল শানপুরের অলিগলি ঘুরেও কোন বড় সুযোগ পাওয়া গেল না। । তবে পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য খাবার খুব সহজেই জোটে যাচ্ছে। সামান্য কষ্ট করে একটা ছোরা দেখাতে পারলেই টাকা পয়সা ঘড়ি মোবাইল পাওয়া যাচ্ছে। ঘড়িটা বেশী পাওয়া যায় না তার পরিবর্তে মোবাইল। বাতেন একটা সিম কিনে মোবাইল ব্যবহার করা শুরু করে। ছিনতাই করা মোবাইল।
ইতিমধ্যে ছোট দেখে একটা বাসা বাড়া নেয় বাতেন। যে এলাকায় থাকে তার আশেপাশে বাতেন কোন খারাপ কাজ ভুলেও করে না। সবই হয় অন্য এলাকায়। কখনো প্যান্ট সার্ট পড়ে শিক্ষিত মানুষ কখনো তালি দেওয়াটা পড়ে বখাটে স্টাইল। আবার কখনো একদম নোংরা কাপড় পড়ে বস্তির অনাহারি মানুষ। সব দিকেই তার লাভের অংকটা হিসেবে থাকে।
ক্রমেই বাতেন একটা পর্যায়ে চলে আসে। নামের মধ্যে পদ্দতি করে ফেলে। মানে ভাই যোগ করে নেয়। বাতেন ভাই নাম শুনলেই তাদের চেলাপেলারা কাঁপতে থাকে। বাতেনের সব চেয়ে বড় গুন্ডামির পরিচয় হল সে চোখের পলকে বুদ্ধি বের করে দুই নাম্বারি কাজ করতে পারে। ছোরা চালাতে পারে। রক্ত দেখে আগে ভয় পেলেও এখন তা না দেখলে মাথাটা খারাপ হয়ে যায়।
একটা সময় এমন হল বাতেনের, তাকে আর কোন কাজে যেতে হয় না। শুধু হুকুম করে। সেই বারো বছর বয়সে শানপুরে আসা বাতেন আর বর্তমান বাতেন অনেক আলাদা। এর মাঝে গ্রামে গিয়ে বাতেন বোনটাকে বিয়ে দিয়েছে। যে আশায় তার সকল গুন্ডামি কাজ শুরু। সেই বোনকে বিয়ে দিয়েও তা পূরণ হয়নি। বোনের জামাই অকারণেই বোনকে মারত। বিড়ির আগুন বোনের শরীরে ধরে থাকতো। বুকের কাপড় খুঁলে স্তনের বোটায় জ্বলন্ত বিড়ি ধরিয়ে তা জখম করে দিতো।
বাতেন বোনের কাছে গেলেও ওই সব কথা বোন বলত না । একদিন ভাইকে খেতে দেওয়ার সময় বোন নিজের বুকের মাঝে হাত রেখে উহ্ শব্দ করে। বাতেন বলে আপা তোর বুকে কী হয়েছে রে?
বড় বোন মায়ের মত, মায়ের বুকে সন্তান খারাপ চোখে তাঁকাতে পারেনা। খাওয়ার থালা সরিয়ে দিয়ে বাতেন বোনের বুকের কাপড় টান দিযে খুঁলে দেখে জায়গা পোড়ে জখম হয়ে গেছে। আর বুঝতে বাদ রইল না, কে করেছে। খাওয়া থেকে ওঠে বলল, "শুয়রের বাচ্চা কোথায়? "
বোন জামাই কোথা থেকে যেন দুলতে দুলতে বাড়িতে আসে। সে কিছু না বুঝতেই বাতেন তার বাম হাতের একটা আঙ্গুল ছোরা দিয়ে কেটে ফেলে বলে, "হারামি বাচ্চা হারামি আমার বোনের শরীরে হাত? গরিব হয়েছি বলে বোনকে যা তা অত্যাচার করবি? বোনের জামাই বলে পুরো হাতটা কাটলাম না। আর যদি একদিন শুনি আপার গায়ে একটা আঁচড় তো দুরের কথা একটা খারাপ কথা বলেছিস। তখন তোকে বোনের জামাই বলে ছেড়ে দেবো না। একেবারে কাল্লাকাইটা ফালামু।"
বাতেন বাড়ি থেকে চলে যায়। যাওয়া আগে বোনকে বলে দুলা ভাইয়ের হাতটা একটা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিস।
বাতেন ভাই ব্রিজের ওপর থেকে নেমে দৌড়ে কোন দিকে যেন যাচ্ছে। পেছন থেকে কে যেন ডাকছে। এতো রাতে আবার কে ডাকে? বাতেন ভাই পেছনে না তাঁকিয়ে দাঁড়ায়, কণ্ঠটা পরিচিত মনে হচ্ছে।
সোনালি তুমি এখানে?
হ, বাতেন ভাই। আমার বাবার অবস্থা খুবই খারাপ। এক ছিনতাইকারির ছোরায় এখন আহত। তুমি তো জানই ওই দিকে কে কাজ করে। তাহলে খবর নেও। হবু শ্বশুরে জন্য কিছু একটা করো।
সেই বারো বছর আগে এক সকালে মাত্র একটা রুটি খেতে চেয়ে তার বদলে গণ পিটুনির শিকার হয় বাতেন যার হুকুমে, সেই লোকই সোনালির বাবা। বাতেন এ কথা স্বরণে রাখলেও সোনালি তা জানে না। তাই শ্বশুরের প্রতি বাতেন তেমনটা আগ্রহী নয়। রাত বাড়ার সাথে ব্রিজের ওপরে চলাচলের লোকের সংখ্যাও ক্রমেই কমে যাচ্ছে। যারা আছে, তাদের অনেকেই মুক্ত দোকানদার।
বাতেন বলল, আমি তো ক’দিন ধরেই ওই কাজ ছেড়ে দিয়েছি। ওই পথে আর পা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই। চলো তোমার বাবাকে বাঁচাতে হলে হাসপাতালে নিতে হবে।
ছোরার আঘাতটা পেটের ডান দিক বরাবর ঢুকেছে। হাসপাতাল বেডে ক্যাশিয়ার সাহেব বাতেনের হাত ধরে বলেন, "তুমি সেদিন কিন্তু আমাকে চাচা বলেছিলে। আজ যেন তা সত্যি হল। তোমার হাতে আমি সোনালিকে দিয়ে গেলাম। সে তোমার দুই সম্পর্কের একজন। এক. চাচাতো বোন. দুই. বউ।" বাপের যাবার বেলায় হঠাৎ করেই সোনালির চোখে মুখে বিয়ের বাতাস লাগতে থাকে। ক্ষণিকেই দক্ষিণা বাতাস তার মনের উথালে সৌরভ দিয়ে গেল।
সোনালিকে নিয়ে বাতেন ভাই নিজের গ্রামের বাড়িতে যায়। এক মাত্র বোনকে ছাড়া বাতেনের জীবনে কিছু নেই। বাতেনের বাড়িতে অনেক লোকের জটলা। বুকের মাঝে যেন একটা কাঁপুনি হল। ভীড় মারিয়ে যেতেই দেখে, বোনের লাশ। লোকদের কাছ থেকে জানতে পারে। গত রাতেই ফাঁস দিয়ে মারা যায়। আজ লাশ বাপের বাড়িতে পাঠায় তার স্বামী।
বাতেনের বিশ্বাস তার বোন ভাইকে একা ফেলে যেতে পারেনা। বোন জামাই যে হারামি, তাকেই বাতেন সন্দেহ করল। আর কিছু না বলে বোন জামাই বাড়ির দিকে যেতে থাকে।
সোনালি বাধা দিয়ে বলে, এই সময় মাথা ঠিক রাখতে হবে। আগে বোনের লাশ কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করো তারপর দেখা যাবে।
ভালো হতে চেয়েও বাতেন ভালো থাকতে পারছেনা। বোন জামাইকে শেষ করে দিয়ে সব খান্ত দিতে হবে। ছোরা হাতে বাতেন দৌড়াতে থাকে।
সোনালি বলে, আর নয় খুন খারাপি আর নয় খারাপ কাজ, তাকে মারলেই কি তুমি তোমার বোনকে ফিরে পাবে? বরং জেল জরিমানা নয়তো ফাঁসিও হতে পারে। তার চেয়ে তাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দাও। আইনই তার সঠিক বিচার করবে।
বাতেন সোনালির কথা ফেলতে পারে না। কেঁদে বলে, বোনটা কি কবরে গিয়ে আমায় বলবেনা, প্রতিশোধ নিতে পারলিনা ভাই?
সোনালি নিজের হাতটা বাতেনের মাথায় রেখে বলল, কিচ্ছু বলবে না। চলো এখন যা কাজ তাই গিয়ে করি।
সমাপ্ত
কবি ও লেখক
সাইফুল ইসলাম
৩০-০৭-২০১২