2016

            
কবি ও কবিতা
  দেয়াল                  

অবুঝ মন কথাটা কিছু ক্ষেত্রে বিলাসীতা
আবার কখনো বাস্তবিক,
ঝুলন্ত সূতার মাঝে পাথরের মত
যাহা নিম্ন দিকে ধাবিত
আবার কখনো ডানে বামে আগে পিছে,
কারণ কারো আঘাতের তেজে
সে স্থান পরিবর্তনে বাধ্য থাকিবে
যদি না সে অপরের চেয়ে ক্ষুদ্র।
তাহার ভালবাসার কাছে আমার-
মন সদাই ছিল অবুঝ
কিন্তু কোন বিলাসীতা ছিল না,
তাহার হৃদয় বড় বিশাল ছিল
যাহার ব্যবধানে আমার ভিতরটা চুরমার
ক্ষত বিক্ষত জীবন্ত লাশ।
আমি কখনো আমার হৃদকে-
সাহসী হতে বলিনি,
যদি প্রিয়ার ফুলের মত মনটারে-
বেদনার বেড়াজালে বাঁধে
তাহলে আমি কেমনে সইবো
কেমনে দেখিবো দু-নয়ন মেলিয়া,
আমি তাহার কাছে উত্তর চাইনি
মনের সাথে যুদ্ধ করেছি
তাহার মাঝে আমার যে দুরত্ব
তাহা কাছের মাঝে লৌহের মত শক্ত
ভাঙার উপায় আমি জানি না।
যে ভালবাসার বন্ধনে তাহারে আমি-
প্রতিচ্ছবি রুপে আয়নার মাঝে দেখিতাম
সমান্তরালে কোন বাঁকা ছিল না,
জোছনা রাতে দু-জন বসে তারা গুনিতাম
হাসনাহেনা ফুল তাদের কাজের ব্যাস্ততার-
মাঝে আমাদের মৌনতা বিলিয়ে দিত।
এখন সম্মুখে একটি কালো চাদর
অপর প্রানে- ধু ধু অন্ধকার
কূয়াশার আবরণ দৃষ্টির সীমানায়,
কখনো কপাট বলা যায়
অথবা বিচ্ছেদের দেয়াল।

                       তারিখ ও সময়:- ২৬-০৯-২০০৫,  ২০/১৫

কবি ও কবিতা
 শানপুর ওভার ব্রিজের ওপর দক্ষিণমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাতেন ভাই। পাশ দিয়ে হাজারো মানুষ চলাচল করছে। কেউ জানতে চাচ্ছে না, সে এখানে এতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কেন? এই শহরটা বড় নিষ্ঠুর, আরও নিষ্ঠুর শহরের মানুষগুলো। রাতের ড্রিম লাইটের আলোর মত মানুষগুলোর মনও ফেকাশে হয়ে গেছে। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। মায়া দয়া বিহীন মানুষের ভীড়ে একজন মানুষ ওভার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে কী চিন্তা করছে, তা কারোর দেখার কথা নয়।
    আকাশে মেঘের কোন ছায়াও নেই। অথচ হঠাৎ করেই ক-পশলা বৃষ্টি নেমে গেল। পথের ধূলি বাতাসে উড়ে পরিবেশটাকে একবারে জগা-খিচুড়ি করেছিল। পথে চলতে গেলে নাকে মুখে আলাদা কাপড়ের টুকরো চেপে ধরতে হয়। কখনো আবার দিনের বেলায় দাউ দাউ আগুনের ফুলকির মত রোদ ওঠে। এই রোদের মধ্যে বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষেরা ছুঁটেছে তাদের নিজেদের কাজে।
    ভোর থেকে ছুঁটে চলছে কম বয়সের অনেক হকাররা। এক গাদা পত্রিকার বান্ডেল নিয়ে এক গাড়ি থেকে আরেক গাড়িতে। অথচ ওই পত্রিকার ওজনের সমানও ছেলেগুলোর ওজন হবে না। জীবনের তাগিদে সবাই ছুঁটছে এক জায়গা থেকে অন্যত্র।
    শানপুর, রাজধানি মতিহারের এক মাত্র বাটপাইয়া এলাকা। এখানে ঘটেনা এমন কোন কাজ নেই। চুরি ডাকাতি ছিনতাই পকেটমার মলমপার্টি থেকে শুরু করে নারী বিষয়ক কাজ। অথচ এখানেই দেশের সব চেয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। আছে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, কারিগরি প্রশিক্ষণ ভিক্তিক বিভিন্ন কলেজ। একদিন এখানের কোন অফিস বন্ধ থাকলে দেশের জন্য অশূভ হয়। এখানে আছে রাজধানির সব চেয়ে বড় কাঁচা বাজার। আছে হোটেল, রেষ্টুরেন্ট, আবাসিক এলাকা।
    এই ব্রিজের ওপর থেকে বাটপাররা মানুষদেরকে টার্গেট করে, কাজ হাছিল করে। কোন লোকেগুলো রাজধানিতে পুরানো ও নতুন আমদানি। ওদের মূল টার্গেট থাকে গ্রাম থেকে আসা লোকদের ওপর। পথে হাঁটার ভাব দেখেই ওরা গ্রামের লোকদেরকে চিনতে পারে।
    বাতেন ভাইও গ্রামের সন্তান। সেই বারো বছর আগে এই শহরে সে এসেছে। কোন এক কাক ডাকা ভোরে বাতেনের শানপুরে পা রাখা। প্রথমেই সে হোঁচট খায়। দূর পাল্লার গাড়িতে করে বাতেন নেমেই একটু প্রকৃতির টানে কাজ সেরে পেছন ফিরে দেখে তার ব্যাগটা নেই। বাতেন হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে। ওখানে তেমন বেশী টাকা পয়সা না থাকলেও দামি জিনিস ছিল।
    বাতেন ব্যাগ রাখা ওই জায়গাটাতে অপলক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ধরে তাঁকিয়ে থাকে। বেলা বাড়তে থাকে। বাতেন সেখানে থেকে সরে না। ভাবে, কেউ যদি ভুলে নিয়ে থেকে আবার ফেরত দিতে আসে, সেই আশায়। শানপুরে পাওয়া বলতে কোন হিসেব নেই, শূধু হারানোর পালা।
    অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাতেন এই শহরে আসে। বাবা-মা হীন এক মাত্র বোনকে বিয়ে দেওয়ার জন্য টাকা কামাই করতে হবে। বাতেন ব্যাগের আশা বাদ দিয়ে দু-হাত দিয়ে চোখ ঘসে চারদিকে তাঁকিয়ে অবশেষে ওপরে তাঁকিয়ে কি যেন ভাবে। বিদুৎ এর তারের ওপর সকাল সকাল কাকের মেলা বসেছে। একটা বাদুরের দেহ তারের সাথে লেগে থাকতে দেখা গেল। বাদুর চোখে দেখে না। কিন্তু কানে শুনার ক্ষমতা তুখোড়। অতি ক্ষুদ্র শব্দও শুনতে পারে। বাদুর শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে চলার পথের দিক নির্ধারন করে পথ চলে। হঠাৎ করেই একটা কাকের পাছার মাল বাতেনের কাঁধে পড়ে। বাম হাত দিয়ে নাকে নেওয়ার আগেই ঘটনা বুঝতে পারে।
    পেটে বাতেনের ক্ষুধা। এমন সময় এই কাজ কাকের ! বাতেন রাগে বলল, শালার কাকের বাচ্চা কাক আর বুঝি জায়গা পেলিনা !  কয়েকজন কাগজ কুড়ানো পোলাপান ওর পাশ দিয়ে পেছনে ছেঁড়া ছালা নিয়ে যাচ্ছে আর বলছে, "আজ হিসেবের খাতায় ভাগটা ভালোই পাবো রে, তাই না?"
    আরেকজন বলছে, "ঠিক তাই। সু-সময় সব সময় আসেনা। কিন্তু ওই লোকের জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছে রে। কি সুন্দর সার্ট ও প্যান্ট পড়া ছিল, তার পেটে মেরে দিলাম ছোরা, পেয়ে গেলাম লাখখানি টাকা। লোকটা মনে হয় শানপুর এসেছিল কোন চাকরির খুঁজে ঘুস দিতে। তাছাড়া মনে হয়না তিনি এখানের স'ায়ী বাসিন্দা।"
    বাতেন, বাম হাতে লাগা কাকের মাল একটা দেয়ালে মুছে ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। কাছে কোন জলের ব্যবস্থা না থাকায় দেয়ালে মোছা। সৃর্যের তাপটা বেড়ে যাচ্ছে, সাথে পেটের ক্ষুধা। খাবার হোটেলে ভিড়। বেশীর ভাগ লোকেরই নাস্তার উপকরণ রুনটি ও ভাজি। কেউবা সাথে ডিমের ওমলেট।
    কাগজ কুড়ানো ছেলেদের দিকে আর নজর না রেখে বাতেন এক হোটেলের কাছে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। পকেটে কোন টাকা নেই। যে ক’টা ছিল তা ব্যাগে ছিল। হোটেলের ক্যাশিয়ার বাতেনের কাছে তার চাচার মত দেখতে। মাথার সামনে কোন চুল নেই, নাকটা লম্বাটে দেহটা মধ্যম ধাচের। একের পর এক লোকজন খেয়ে যাচ্ছে। অনেকেরই খেয়েও কিছু ফেলে যাচ্ছে, সেগুলোও যদি বাতেন খেতে পারে ক্ষুধা থাকবে না। তবে বাতেন ওগুলো খাবেনা। সে তো ফুটপাতের টোকাই না। ব্যাগটা চুরি হওয়ার কারণে বাড়ি থেকে আনা খাবার...।
    বাতেনের জিহ্বা্‌ দিয়ে জল পড়ছে। ক্ষুধার কারণে চোখে মুখের জল শুকিয়ে গেছে। করুণ দৃষ্টিতে ক্যাশিয়ারে দিকে তাঁকিয়ে আছে সে, যাতে তিনি ওর দিকে তাঁকায় কিনা দেখতে। একটা পাঁচশত টাকা নোট আলোতে নিয়ে দেখতে গিয়েই ক্যাশিয়ারে নজরে পড়ে বাতেন। বলে, এই ছোকরা, ওমন কুকুরের মত হা করে আছিন কেন? এই টাকা ছিনিয়ে নিবি নাাকি?
    বাতেন মাথা নাড়ে, "না।"

    বলতে চায়, "একটা রুটি...!"
    ক্যাশিয়ার তাঁদের লোকগুলোকে বলল, ধর এই ছিনতাইকারিকে। আমার পাঁচশত টাকা ছিনতাই করতে চাচ্ছে। 
    বাতেন তখনও বলছে, "না, না। শুধু একটা রুটি... চাচা?"
    লোকগুরো তেড়ে আসতেই ক্যাশিয়ার তাদেরকে হাত দিয়ে আঁটকে বলল, "কে তোর চাচা? আমার তো কোন নিদিষ্ট মা বাপই নেই। কার গর্ভে জন্ম তাই তো জানিনা। তুই আবার ভাতিজা হলি কবে? শালার বেটা আমাকে ভুলাতে চাচ্ছিস না? এ খাড়া দেখাচ্ছি মজা।"
    বাতেন তখনও বলে যাচ্ছে, "একটা রুটি..., চাচা?"

    বাতেন যখন নিজেকে সৃষ্টি করল তখন সে একটা ময়লার স্তূপের কাছে পড়ে আছে । নাকে যেন হঠাৎ করেই গন্ধ ঢুকলো। অচেতন থাকলে নাকে গন্ধ যায় না ! পঁচা সবজির গন্ধ, ডিমেরর গন্ধ, ফুটপাতে বড় হওয়া মানুষের গুয়ের গন্ধ, পথ দিয়ে হাঁটা সবার পেচ্ছাবের গন্ধ। বাড়ি থেকে পড়ে আসা বোনের ধোয়া দেওয়া সার্ট প্যান্টের অবস্থা আর আগের মত নেই।
    বাতেনের চোখ দিয়ে টপাটপ জল পড়ছে। যে আশা নিয়ে সে এই শহরে এসেছে তার যে কতটা পূরণ করতে পারবে তা ভেবে বাতেন আরও কাঁদতে থাকে। যে করেই হোক সাফল্য তাকে পেতেই হবে। একমাত্র বড় বোনকে বাতেন বিয়ে না দিয়ে বুড়ো হতে দিতে পারে না। বাতেনের চোখের সামনে ভাসছে, তার বোন বিয়ের আসরে বসে আসে। সাথে বোন জামাই। বাতেন আজ মহাখুশি। জীবনের একটা শ্রেষ্ট চাওয়া পূরণ হল। তাই স্রষ্টার দরবারে দোয়া করছে।
    হঠাৎ কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ে বাতেনের ধ্যান ভেঙে যায়।। ওরা এখন ওই ময়লা থেকে খাবার বের করে খাবে তাই কাছে অন্য জাতির উপস্থিতি কামনা করছে না। সাদা কালো নীলসহ পাঁচ সাতটা কুকুর বাতেনের দিকে তঁকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে শালার  মানুষ তোরাও এখন আমাদের খাবারে ভাগ বসিয়েছিস? একটা কুকুর তার লেজ ঘুরিয়ে তেজী ভাব দেখাচ্ছে। মনে হয় বাতেনের উপর হামলা করবে খাবারে ভাগ বসানোর অপরাধে।
    বাতেন আর কিছু না ভেবে অন্য দিকে চলে গেল। এই শহরে কেউ তার আপন বলতে নেই। ঠিক ক্ষুধার সময় যদি খাওয়া না যায় তবে পরে আর তা থাকে না। বাতেনের অবস্থা হয়েছে তেমন। ইহা আর কতক্ষণ থাকবে ! খেতে তো হবেই। বাতেন ভাবছে, টাকা কামাই করি আর নাই করি আগে নিজের জীবন বাঁচাতে হবে। জীবনই যদি না বাঁচে তবে টাকা কামাই করে বোনকে বিয়ে দেওয়া হবে না। এভাবে না খেয়ে মরা যাবেনা। কিন্তু কী করা যায় ! যাই করতে যাই না কেন তার জন্য পুঁজির দরকার। তা কোখায পাবো ! না পাওয়ার আশাই বেশী। করতে হবে চুরি, করতে হবে ডাকাতি, করতে হবে ছিনতাই। জীবনের ছিনতাই্‌ করিনি, ছিনতাই না করেই গণ পিটুনি খেয়ে ময়লার ওপর এক রাত থাকতে হয়েছে আমাকে। তাহলে সেই ছিনতাইকারিই হবো আমি। এলাকার সেরা ছিনতাইকারি, সেরা বাটপার, সেরা সন্ত্রাসী।
    নিজের মাঝে নিজেকে তেজী ভাব দেখাতে গিয়েও পেলো না বাতেন। একটা কিছু দিয়ে পেটটা ভরানো চাই। কি খাবো, মানুষ হয়ে তো ঘাস গোবর লতা পাতা খেতে পারিনা !
    সন্ধা হয়ে আসছে দুপুরে একটা অর্ধ খাওয়া রুটি জোটেছিল। একটা মেয়ে খাইতেছিল, তা চাইতেই মেয়েটা দিযে দেয়। মায়াহীন মানুষের ভিড়ের ক’জন মায়ার মানুষ এই দুনিয়ায় এই শহরে আছে। ওই তো এক অর্ধ বুড়ো লোক হাতে করে কি যেন নিয়ে যাচ্ছে। খাওয়ার জিনিসই হবে মনে হচ্ছে। ডান পাশে একটা গলি আছে, ছিনতাই করে ওদিকে দৌড় দিবে বাতেন ভাবছে। আর ওই বুড়োর কাছ থেকে জিনিস নিতে আবার দৌড় দিতে হবে ! একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে ।
    বুড়ো একটা হালকা চিৎকার করলেন। ক’জন মানুষ আসতে চেয়েও এলোনা। এই শহরে সবাই নিজের জন্য ব্যাস্ত। কোথায় কে ছোরার আঘাত খেলো না খেলো তা নিয়ে কারোর মাথা ব্যাথা নেই। না ! বুড়ো তাঁর পুটলায় ভালোই কিছু রেখেছেন। সবই খাবার জিনিস। একটা ছোট বাক্সের ভিতরে কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে। কয়েকটা বাঁধ দেওয়া তাতে। বাতেন তা খুলে দেখল। একটা কাঠের তৈরি পুতুল। হয়তো বুড়ো তাঁর ছোট কোন নাতি নাতনিকে দিতে কিনেছিল।
    বাতেনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছিনতাইকারিদের মন তো খারাপ হওয়ার কথা নয়। ক্ষণিকেই মনটা ছোট বাচ্চাদের মত হয়ে গেল। যা-ই হোক, বাতেন খেয়ে পেটটা ঠান্ডা করে নিল। আজ রাত থেকেই বাতেন তার মূল পরিকল্পনায় কাজ শুরু করবে। কী দিয়ে শুরম্ন করা যায় তাই ভাবে।
    দুদিনে হয়ে গেল শানপুরের অলিগলি ঘুরেও কোন বড় সুযোগ পাওয়া গেল না। । তবে পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য খাবার খুব সহজেই জোটে যাচ্ছে। সামান্য কষ্ট করে একটা ছোরা দেখাতে পারলেই টাকা পয়সা ঘড়ি মোবাইল পাওয়া যাচ্ছে। ঘড়িটা বেশী পাওয়া যায় না তার পরিবর্তে মোবাইল। বাতেন একটা সিম কিনে মোবাইল ব্যবহার করা শুরু করে। ছিনতাই করা মোবাইল।
    ইতিমধ্যে ছোট দেখে একটা বাসা বাড়া নেয় বাতেন। যে এলাকায় থাকে তার আশেপাশে বাতেন কোন খারাপ কাজ ভুলেও করে না। সবই হয় অন্য এলাকায়। কখনো প্যান্ট সার্ট পড়ে শিক্ষিত মানুষ কখনো তালি দেওয়াটা পড়ে বখাটে স্টাইল। আবার কখনো একদম নোংরা কাপড় পড়ে বস্তির অনাহারি মানুষ। সব দিকেই তার লাভের অংকটা হিসেবে থাকে।
    ক্রমেই বাতেন একটা পর্যায়ে চলে আসে। নামের মধ্যে পদ্দতি করে ফেলে। মানে ভাই যোগ করে নেয়। বাতেন ভাই নাম শুনলেই তাদের চেলাপেলারা কাঁপতে থাকে। বাতেনের সব চেয়ে বড় গুন্ডামির পরিচয় হল সে চোখের পলকে বুদ্ধি বের করে দুই নাম্বারি কাজ করতে পারে। ছোরা চালাতে পারে। রক্ত দেখে আগে ভয় পেলেও এখন তা না দেখলে মাথাটা খারাপ হয়ে যায়।
    একটা সময় এমন হল বাতেনের, তাকে আর কোন কাজে যেতে হয় না। শুধু হুকুম করে। সেই বারো বছর বয়সে শানপুরে আসা বাতেন আর বর্তমান বাতেন অনেক আলাদা। এর মাঝে গ্রামে গিয়ে বাতেন বোনটাকে বিয়ে দিয়েছে। যে আশায় তার সকল গুন্ডামি কাজ শুরু। সেই বোনকে বিয়ে দিয়েও তা পূরণ হয়নি। বোনের জামাই অকারণেই বোনকে মারত। বিড়ির আগুন বোনের শরীরে ধরে থাকতো। বুকের কাপড় খুঁলে স্তনের বোটায় জ্বলন্ত বিড়ি ধরিয়ে তা জখম করে দিতো।
    বাতেন বোনের কাছে গেলেও ওই সব কথা বোন বলত না । একদিন ভাইকে খেতে দেওয়ার সময় বোন নিজের বুকের মাঝে হাত রেখে উহ্‌ শব্দ করে। বাতেন বলে আপা তোর বুকে কী হয়েছে রে?
    বড় বোন মায়ের মত, মায়ের বুকে সন্তান খারাপ চোখে তাঁকাতে পারেনা। খাওয়ার থালা সরিয়ে দিয়ে বাতেন বোনের বুকের কাপড় টান দিযে খুঁলে দেখে জায়গা পোড়ে জখম হয়ে গেছে। আর বুঝতে বাদ রইল না, কে করেছে। খাওয়া থেকে ওঠে বলল, "শুয়রের বাচ্চা কোথায়? "
    বোন জামাই কোথা থেকে যেন দুলতে দুলতে বাড়িতে আসে। সে কিছু না বুঝতেই বাতেন তার বাম হাতের একটা আঙ্গুল ছোরা দিয়ে কেটে ফেলে বলে, "হারামি বাচ্চা হারামি আমার বোনের শরীরে হাত? গরিব হয়েছি বলে বোনকে যা তা অত্যাচার করবি? বোনের জামাই বলে পুরো হাতটা কাটলাম না। আর যদি একদিন শুনি আপার গায়ে একটা আঁচড় তো দুরের কথা একটা খারাপ কথা বলেছিস। তখন তোকে বোনের জামাই বলে ছেড়ে দেবো না। একেবারে কাল্লাকাইটা ফালামু।"
    বাতেন বাড়ি থেকে চলে যায়। যাওয়া আগে বোনকে বলে দুলা ভাইয়ের হাতটা একটা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিস।
    বাতেন ভাই ব্রিজের ওপর থেকে নেমে দৌড়ে কোন দিকে যেন যাচ্ছে। পেছন থেকে কে যেন ডাকছে। এতো রাতে আবার কে ডাকে? বাতেন ভাই পেছনে না তাঁকিয়ে দাঁড়ায়, কণ্ঠটা পরিচিত মনে হচ্ছে। 
    সোনালি তুমি এখানে?
    হ, বাতেন ভাই। আমার বাবার অবস্থা খুবই খারাপ। এক ছিনতাইকারির ছোরায় এখন আহত। তুমি তো জানই ওই দিকে কে কাজ করে। তাহলে খবর নেও। হবু শ্বশুরে জন্য কিছু একটা করো।
    সেই বারো বছর আগে এক সকালে মাত্র একটা রুটি খেতে চেয়ে তার বদলে গণ পিটুনির শিকার হয় বাতেন যার হুকুমে, সেই লোকই সোনালির বাবা। বাতেন এ কথা স্বরণে রাখলেও সোনালি তা জানে না। তাই শ্বশুরের প্রতি বাতেন তেমনটা আগ্রহী নয়। রাত বাড়ার সাথে ব্রিজের ওপরে চলাচলের লোকের সংখ্যাও ক্রমেই কমে যাচ্ছে। যারা আছে, তাদের অনেকেই মুক্ত দোকানদার।
    বাতেন বলল, আমি তো ক’দিন ধরেই ওই কাজ ছেড়ে দিয়েছি। ওই পথে আর পা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই। চলো তোমার বাবাকে বাঁচাতে হলে হাসপাতালে নিতে হবে।
    ছোরার আঘাতটা পেটের ডান দিক বরাবর ঢুকেছে। হাসপাতাল বেডে ক্যাশিয়ার সাহেব বাতেনের হাত ধরে বলেন, "তুমি সেদিন কিন্তু আমাকে চাচা বলেছিলে। আজ যেন তা সত্যি হল। তোমার হাতে আমি সোনালিকে দিয়ে গেলাম। সে তোমার দুই সম্পর্কের একজন। এক. চাচাতো বোন. দুই. বউ।" বাপের যাবার বেলায় হঠাৎ করেই সোনালির চোখে মুখে বিয়ের বাতাস লাগতে থাকে। ক্ষণিকেই দক্ষিণা বাতাস তার মনের উথালে সৌরভ দিয়ে গেল।
    সোনালিকে নিয়ে বাতেন ভাই নিজের গ্রামের বাড়িতে যায়। এক মাত্র বোনকে ছাড়া বাতেনের জীবনে কিছু নেই। বাতেনের বাড়িতে অনেক লোকের জটলা। বুকের মাঝে যেন একটা কাঁপুনি হল। ভীড় মারিয়ে যেতেই দেখে, বোনের লাশ। লোকদের কাছ থেকে জানতে পারে। গত রাতেই ফাঁস দিয়ে মারা যায়। আজ লাশ বাপের  বাড়িতে পাঠায় তার স্বামী।
    বাতেনের বিশ্বাস তার বোন ভাইকে একা ফেলে যেতে পারেনা। বোন জামাই যে হারামি, তাকেই বাতেন সন্দেহ করল। আর কিছু না বলে বোন জামাই বাড়ির দিকে যেতে থাকে।
    সোনালি বাধা দিয়ে বলে, এই সময় মাথা ঠিক রাখতে হবে। আগে বোনের লাশ কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করো তারপর দেখা যাবে।
    ভালো হতে চেয়েও বাতেন ভালো থাকতে পারছেনা। বোন জামাইকে শেষ করে দিয়ে সব খান্ত দিতে হবে। ছোরা হাতে বাতেন দৌড়াতে থাকে।    
    সোনালি বলে, আর নয় খুন খারাপি আর নয় খারাপ কাজ, তাকে মারলেই কি তুমি তোমার বোনকে ফিরে পাবে? বরং জেল জরিমানা নয়তো ফাঁসিও হতে পারে। তার চেয়ে তাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দাও। আইনই তার সঠিক বিচার করবে।
    বাতেন সোনালির কথা ফেলতে পারে না। কেঁদে বলে, বোনটা কি কবরে গিয়ে আমায় বলবেনা, প্রতিশোধ নিতে পারলিনা ভাই?
    সোনালি নিজের হাতটা বাতেনের মাথায় রেখে বলল, কিচ্ছু বলবে না। চলো এখন যা কাজ তাই গিয়ে করি।                          
                                                            সমাপ্ত                             
কবি ও লেখক
সাইফুল ইসলাম
৩০-০৭-২০১২

কবি ও কবিতা

ভালবাসার ঠিকানা 

ভালবাসা তুমি গগণের মাঝে-
সবগুলো মেঘের ছড়াছড়ি,
ভালবাসা যেন সাগর তীরে ছোট-
বড় অনেকগুলো তরী।
ভালবাসা সেতো ফুটন্ত ফুলের উপর-
উড়ে আসা ভ্রমরের গুঞ্জন,
ভালবাসা সেতো হাওয়ায় উড়ানো-
প্রিয়ার চুলে প্রেমের বন্ধন।
ভালবাসা মানে জোছনা রাতে উদিত
মিটি মিটি তারাগুলো,
ভালবাসা মানে সন্ধা রাতে আধাঁর-
মাঝে পূস্ফুটিত আলো।
ভালবাসা সেতো পাহাড় থেকে কলকল-
বেগে আসা ঝরনা ধারা,
ভালবাসা সেতো পূর্ণিমার রাতে,
পূর্ণ আলো দিয়ে ভরা।
ভালবাসা যাবে বহুদূর ঠিকানাহীন-
অসীম পথ প্রান্তরে,
ভালবাসা কিছু গান কিছু কথা,
লুকিয়ে থাকে অন্তরে।
ভালবাসা সেতো দুখের মাঝে সুখ-
খোঁজে নেয় প্রিয়ার সন্ধান,
ভালবাসা সেতো মায়াবী মুখের,
মিষ্টি হাসি ভরা কলতান।
ভালবাসা ধীরে ধীরে হেঁটে যায়-
কোন অজানা স্নিগ্ধতার খোঁজে,
ভালবাসা কাহারো হৃদয়ে আসন নেয়-
দুটি মনের আঙ্গিনা বুঝে।
ভালবাসা কখনো চপলা নারীর-
চুলের খোঁপায় বাঁধানো বকুল মালা,
ভালবাসা কখনো বহতা নদী বেগে-
বয়ে যায় হৃদয় থেকে হৃদয়ে চলা।
ভালবাসা সেতো জোছনা রাতের-
লক্ষ তারার ঝিকিমিকি আলো,
ভালবাসা  নজর ফেলে ঐ নীল গগণে,
দেখতে লাগে ভালো।
ভালবাসা সেতো বহুদূরে যেতে চায়-
কোন স্বপ্ন প্রেমের দেশে,
ভালবাসা অনন্ত, চিরন্তন,
থাকতে চায় সুখ বেশে।
তারিখ ও সময়:- ০৬/০৬/২০০৫, ১৫-৩৫

                                                              
কবি ও কবিতা
      
     দোকাদারের কাছে এক হালি ডিম কিনতে গেছে ফজলুল হক ওরফে ফজু। বয়স ছয় কি সাত হবে। মুখে কোন গোফ দাড়ির বালাই নেই। নাপিতের কাছে গিয়ে মাঝে মাঝে চাচা  ডাক দিয়ে বলে, একটু এই দিকে টান দিয়ে দেওয়া যায় বেস্নড দিয়ে?
    নাপিত সাহেব ফজুর দিকে তাঁকিয়ে থেকে বলেন, বয়স কত হল তোমার?
    বয়সের সাথে গোফ দাড়িতে ব্লেড ধরার কী সম্পর্ক আছে?
    কোন কথায়ই যখন কাজ হয় না তখন একটু দূরেই দেখতে পায় তার বাপ আসছে নাপিতকে চুল কাটার বিল দিতে। ফজু চুপ করে বলে, ঠিক আছে ভালো করে চুল কাটেন। ওসব কথা এখন বাদ।
    নখ কাটার কথা বলে অন্য দোকানদারের কাছ থেকে একটা ব্লেড কিনে নিয়ে বাড়িতে বাথরুমে ঢুকে গোফ দাড়ি কাটতে থাকে। দু-টান না দিতেই উহ্‌ বলে মৃদূ চিৎকার করে।
    বাহির থেকে ওর মা বলেন, কিরে ফজু ভিতরে কি করছিস?
    না মা কিছু হয়নি। পিঁপড়ায় কামড় দিয়েছে।
    তুই বুঝি ওখানে গিয়ে গুড় খাচ্ছিস? গুড়ের প্রতি পিঁপড়ার বেশী আর্কষণ থাকে।
    মা চুপ থেকে অন্য কাজে চলে যান। বাথরুমে থেকে বের হয়ে আসে ফজু। গোফের এক দিকে কাটা দাগ। রক্ত বের হচ্ছে। খাওয়ার সময় মা বলেন, ওখানে বুঝি পিঁপড়ায় কামড় দিয়েছে রে?
    ফজু মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
    দোকানদার চারটা ডিম দিলেন। ডিম নিয়ে ফজু বাড়ির দিকে যাচ্ছে আর ভাবছে, এতোটুকু মুরগি ! আর সে ডিম পাড়ে কত বড় বড় ! কিন্তু কীভাবে সম্ভব। এই গোপন রহস্য এখন বাড়িতেই গিয়ে মুরগি হাতে নিয়ে দেখতে হবে। এ সব কথা ভেবে ফজুর মনে কিছু সৃষ্টির আকাঙ্খা হল। মায়ের কাছে কেনা ডিম দিয়ে ঘরে থাকা একটা খাঁচায় ভাত দিয়ে উঠোনে ডিম পাড়া মুরগিদেরকে ডাকছে।
    মা বলছেন, মুরগি ধরে কি করবি? গতকাল না এক মোরগ জবাই করে তার মাংস রান্না করে খাওয়ালাম।
    ফজু চুপ, আপন মনে মুরগিদেরকে ডাকছে। নাহ ! মুরগিরা খাঁচায় ধরা দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ঘরের বেড়ায় আঁটকানো রাখা বরঁশিতে কেঁচো দিয়ে উঠোনে ফেলে রাখে । ব্যাস, মুরগি তা খেয়ে ফেলে। ফজু খুশিতে তা ধরে টেনে বরঁশি বের করতে চেষ্টা করে। চেষ্টায় সফল হল ঠিকই কিন্তু ততক্ষনে মুরগি আর নেই। মরা মুরগি হাতে নিয়ে বলছে, এই মুরগি এখন ডিম বের কর। আমি দেখবো কেমন করে অতবড় ডিম বের হয়।
    রান্না ঘর থেকে মা এসে ফজুকে একটা থাফড় মেরে বলল, এ তুই কি করলি? ডিম পাড়া মুরগিটাকে এমন ভাবে মারলি? খাড়া তোর ডিম নিয়ে গবেষণা দেখাচ্ছি।
    মায়ের হাতে দাদার হাঁটার ষ্টিলের লাঁঠি। মরা মুরগি ফেলে ফজু এক দৌড়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে ভাবে, মুরগিটা মারা গেল কেন? কোন সমাধান পেলো না। দুপুর হয়ে গেছে। লাঁঠির ভয়ে ফজু খেতেও যায়নি বাড়িতে। পেটটা ক্ষূধায় চোঁ চোঁ করছে।
    ফজুর মা বাবা দুপুরে খাওয়ার পর একটু ঘূমায়, তখন রান্না ঘরে কেউ যায় না। এই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। ফজু নিজের ভাবনা মত এগিয়ে চলছে। মায়ের ঘরে দরজাটা অর্ধেক খোঁলা আছে। বারান্দায় একটা চেয়ার ও তার কাছে বাবার এক জোড়া জুতো আছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে বাবা চেয়ার থেকে উঠে জুতো খূঁলে ঘরে গেছেন।
    ফজুর চোখ ঘরের দিকে তাঁকানো কিন্তু পাদ্বয় রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ রান্না ঘরের সামনের এক বদনার সাথে ফজুর পায়ের টক্কর লেগে বদনার পানি পড়ে গিয়ে একটু শব্দ হয়।
    ঘর থেকে মা বলেন, কে রে? ফজু? ফজু মুহূর্তেই ঘরের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। মা আরেকবার বললেন, এই ফজু? ভাত পাতিলেই আছে, থালাও ধোয়া আছে শুধু বেড়ে খেয়ে নি। আমার শরীরটা ভালো না।
    ফজু বুঝতে পারছেনা। মা তার ছায়াও দেখেনি, তাহলে ফজু নাম কেমনে বললেন?
    তিনি মা, পৃথিবীতে আপনজনের মধ্যে প্রথমের প্রথম। ফজু আর কিছু না ভেবে কিছুটা বেশী সাহস নিয়ে ঘরে ঢুকে খেতে থাকে। শব্দ হলেও কে কে বলে মা আর ডাকবেন না। রান্না হয়েছে ডিম। নাহ্‌ ডিম ফজু খাবেনা। যা নিয়ে গবেষণার পালায় ফেল তা খাওয়া যাবেনা। আর কি আছে ভেবে অন্য পাতিলে খূঁজতে থাকে। মুরগির তরকারি, টুকরার মধ্যে আছে দুটো পা, গলা ও গিলা(যার মধ্যে পরিপাককৃত খাদ্যের অপ্রয়োজনিয় অংশ থাকে)। গলা খাওয়া গেলেও পা ও গিলার কথা ভাবতেই কেমন যেন বমির ভাব হল ফজুর। নাহ্‌ এসব দিয়ে ফজুর খাওয়া হবে না। কিন্তু ক্ষূধার কি হবে? পেট বলছে খাবো কিন্তু মুখ ?
    সব কথা বাদ দিয়ে হঠাৎ করেই গিলা দিয়ে মাখানো দুটো ভাত ফজু মুখে পুরে দেয়। কই ! তেমন খারাপ তো লাগছে না। ফজু খাবার খাচ্ছে। খাওয়ার ফাঁকে দুই দুইটা মুরগি রান্না ঘরে গিয়েছিল খাবারের আশায়। ফজু ধরতে গিয়েও বাধার মুখে পড়ে মায়ের সেই ষ্টিলের লাঁঠির কথা মনে করে। ভাবে নাহ্‌, কোন ভাবেই মায়ের হাতে দাদার ওই ষ্টিলের লাঁঠির মার খাওয়া যাবে না। বন্ধুরা কেউ যদি শুনে তবে স্কুলে গেলে মুখ দেখানো যাবেনা। তারাতারি খেয়ে খাল থেকে কিছু মাছ ধরে নিয়ে আসি। মা তাতে খুশিই হবেন, সকালে মারা মুরগিটার কথা আর মনে রাখবেনা। কিন্তু' টেংরা ও শিং মাছেরা যে হুল ফোটায়, তাতে বিষণ ব্যাথা করে। তাহলে কি করা যায়? কি করলে মাকে শান্তনা দেওয়া যায়? এসব কথা ভাবতে ভাবতে ধ্যানে পড়ে খাওয়া শেষ না করেই।
    ও দিকে থালার ভাত সব সেই দুটো মুরগি সাবাড় করছে। মায়ের ডাকে ফজুর ধ্যান ভাঙে। দেখে থালায় ভাত নেই। পাশেই মুরগি দুটো আরামে বসে ঘূমাচ্ছে। রাগে ফজু লাঁঠি দিয়ে মুরগিদের প্রতি তাড়া করতেই দুয়ারে ফেলা পানিতে পা পিছলে পড়ে গিয়ে দরজার সাথে আঘাত খেয়ে মা গো বলে চিৎকার করে। কপালে বেয়ে রক্ত বের হয়।
    মা বললেন কি হয়েছে রে ফজু?
    না মা, কিছু না। মুরগি দুটো যন্ত্রনা করছে তো তাই।
    ফজুর পেট ভরেনি খাবারে। পাতিলেও ভাত নেই। দুঃখে ফজু নিজের গালে হাত রেখে বসে ভাবছে। আজকের দিনটাই শালার ডিম ও মুরগি নিয়ে ভেবে গোল্লায় গেল।
                                                            সমাপ্ত
                                                                                            ০৬-০৮-২০১২

শ্যামল বাংলা

আমার স্বাধীনতা, সমীরণে দোলমান
রক্তের মূল্যে অমূল্যে রতন পেয়ে ধন্যিপার,
জুলুমাতে দিয়ে জখমা ক্লান্তির রুপ-
চলে কাপুরুষ কায় রক্ত আর্বে অমানুষি,
জন্ম অবহেলায় মানবতার অভিষাপে
তাহারা পালায় পালা ক্রমে রঙ্গ ভঙ্গিতে,
ফেলে দেই নর্দমার গর্তে যাযা খেলি
জাহান্নামে পড় নাস্তিকের দুয়ারে তব র‌্যালি,
জয় মোদের ক্ষয় তোদের সর্বামূলে
জোছনার কোলে জোছনা নামে জননীর কোলে
পতাকার তলে বাংলা আমার উন্নত মম শিরে।
২৯
অমিয় তৃষ্ণার আর্বে লেলিহার খঞ্জর বাওয়া

দুনিয়া কাঁপানো কাবুলায় রক্ত কোষান্তর,
পতাকা বাংলার, কান্ডারি বাঙালি,
ভেসে থাকে রুপ মরিতার ভাবাবেগে জালিকা
খোস আমদেদ বানুকায় আনন্দ সারিকা
তাহার আপনা জ্বলে রত্ন ভান্ডারে তন্দ্রিমা,
উহা পুস্প আঁকড়ে জন্মভূমি আমার
রক্তে মিশে মৃত্তিকার কণা অহরহ সমাহার
বাঁধিয়া লই কোথায় কিহে আর পাবো ?
জগৎ দুয়ারে জানিতো নেই এমন মধুলতা
শ্যামল বাংলা রুপসী বাংলা বাঙালির চৈতনে গাঁথা।
-০-



কোকিলের কূহু ডাকে ফিরে দেখা শ্যাম কালা
হিমালয় থেকে নামে সূভনিয় জল,
কার্তিকের মাঠে চেতনার কাব্য ভরা ফানুষি
দূর বহুদূর আত্মার রাঙা আলতা,
বধূয়ার খোঁপায় বেলী চাঁপার সমতল মৌনতা,
বাঁশ বাগানের উপর জোছনার রজনী,
হেসে টল ঝুরির বাওয়া,
মধু মালতীর নিশ্চুপ গল্পের আঙ্গিনা,
যেন বেলা ! ফাগুনের রাতে কূয়েলিয়ার বাও-
ভেসে আসা হাসনাহেনার রুপ কামিনী
যৌবনের বিশালে প্রভাতে সুখ পিয়াসা
২০
আমি থাকিবো বাঁচিয়া বহুকাল জুড়ে-
এই ঘাসের সনে, ঘুমিয়ে থাকা আবেশে
কিংবা জাগ্রত জালে লুটোপুটি দিব্য নমুনায়,
আমি স্বপ্নে রাঙবো বাতাসে বাতাসে-
এই জল এই মাটির খাঁটি রুপ মর্মতায়,
আমি যথাই থাকিবো কালেকালে
অলিগলিতে কৃষকের লাঙ্গল জোয়ালে-
শীতের থরথর বুড়োর কাঁপনে,
আঁচলে মোছা ঘামের গন্ধরায় তানে
ফতফত করে উড়ো ঘুড়ির পাখনায়
মাছরাঙা পাখির পলাতক ঠোঁটের ধারে
 ২১
কৃষানের কুলায় ছড়িয়ে পড়ি আগলে
হাতে পায়ে জড়ানো ধানে-
নবান্নের দিগন্ত মাঠে,
আমার বুকের পিনায় থাকে শান্তনার বোধ,
আমি কোথায় ঘুমাবো কোন আঙ্গিনায় ?
সর্বাঙ্গে মায়ের আঁচল ভরা শান্তির ঘুম,
ঢেঁকির চালের তলে দেখি স্বাধীন সত্তা,
পুকুরের জলে ধোয়া বধূয়ার এলোচুলে বাসনা,
আম কুড়াতে সুখের দিব্য সমীহা
জামের রসে ঠোঁটের রং, কুমারী মেয়ের-
তাঁকানো ফুলতায় মায়ারী ঠোঁটে চুম্বন


কবি ও কবিতা
কার্তিকের মাঠে চরাকার, ধরাশান ছোঁয়ে-
আঁকি পয়রা তিমির বেলা হৃদয়ে
মাঠের মাঠ রক্তের দামে
হেঁটে চলা আত্মার টানে মহিলাল মর্মে
জ্যাতিকায় আলোক প্রভা
হেমন্তের ঘরে ঘরে চালের কি সোভা !
খড়ের মাদুলিতে আঁকা ছবি মনা
কাঁধে ধানের গন্ধরাজি বাজিমাত পিয়ানা,
দূরের চোখে রাঙা আলতা বধূয়া
খোঁপায় চামেলির বসত প্রিয়া
রন্দ্রে রন্দ্রে ফানুকায় যৌবনের দিশা দিয়া।

ঘাসের বুকে আমার আপনা ঘুমায় সাধে
সুখের নীড়ে, যাতনার র‌্যালি দূর কাঁদে,
বাতাসের মাঠে দেখা নিঃশ্বাসের আবেশ
চির মৌনতার দুপায়ে ভালথাকার বেশ,
কামনার দুয়ারে হাঁকে হাসি তামাশা
শিশির  শিমুলে শিহরণের নেশা-
উড়ে চলা বক পক্ষীর দল পল
ছান্দনিক সংসারে আসে সুখ ঝলমল
রোদেলা আকাশে আলোর চুম্বন পাহারা
আঁকড়ে বাঁধি পান্থশালার নির্মল তারা
দেখি কোথাও নেই, এহেন বাংলার ধারা।

আসি তাই ফিরে বাংলার মাঠে ঘাটে
তপ্ত বালুকাময় কিংবা কাদার নাটে
জল কামনায় নদী মোহনার বুকে-
পরশ পেয়ে ধন্য হই চৈত্র বৈশাখে,
আসি মর্মে আত্মার টানে রক্তে
দেখি স্বপন বঙ্গিতি গানের সাথে,
ভোর বিহানে পাখির কিচিমিচি ডাকে-
ছুটে চলা দামিনী, ভুলিবার নহে তাকে
কলবরে কৃষানের কাব্যের তালে
গল্পের আসরে মজিবার সোয়ারি ঢালে
খাঁটি মাটির সাথে জড়ায়ে বাহু তলে।



ক্ষীণ বাওয়া, যেন পদাঙ্ক পলে কাল ফনা
                  বিষকায় বিষ ধলে,মুহূরী কালো মর্মিতা
                                               রুদ্ধ পেহলি নিপাতে যৌবন যবে লুপতি
                                                                      ঠাঁই নেই এবে, যাও দূরে যেথা পাও কাল
                                                                                        পৃথিবীতে সঙ্গখেলা দুয়ারে মিলি অহেরি।
                                                                       দিবেনা তল কার্যে আবার জিন্দা দিনকাল
                                             বৃথাই থাকো শুয়ে মৃ্‌্‌তি্রকায় জনম স্মৃতি
                   যামিনী হানে ছল্লাবার পিশে বক্ষ রন্দ্রেতা
নিভে যায় গিয়াছে রক্ত তিথি মৃত মরণা।



                                                                                  এবে ছিলি,আজি নেই,ফানা ফানা বন্দি জাল
                                                       হয়ে থাকে হবে এমনি তৃষা চমক পাতি
                              ফুল মরনে যাও পবনে সত্যিতো সবিতা
বিধিতায় শ্যাম গাঁথা নিলয় যাবার মনা,
                            ধনমান মল্লিকা বহর মানবী তিথিতা
                                                        সবে পর নীড় অপর দাউ দাউ হিলতি
                                                                                    নর্দমায় পস্তাবত অনন্তকাল সেকাল।


    গত তিন দিন ধরে বশির স্কুলে যায় না। আমেনা বেগমও ওকে স্কুলে যেতে তাগিদ দেন না। বশির উঁচু টিবির ওপর একা বসে কী যেন ভাবছে। ওখানে সে প্রায়ই বসে থাকে। আমেনা বেগম সকাল থেকে বশিরকে খুঁজছে। না খেয়ে ছেলেটা কোথায় গেল ! বশির মা মা ডাক দিয়ে এসে বলল, খেতে দাও খুব ক্ষুধা পেয়েছে। বশির খাবার খাচ্ছে ও বলছে, জানো মা আজ আমার মনটা খুব ভাল লাগছে। তোমার মুখ পানে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, কত যেন মায়া ওতে লেগে আছে। 
তোর মুখে এই সব কথা আগে তো কভু শুনিনি। আজ কি হয়েছে রে তোর?
একটু আগে একজন বুড়ো মহিলার সাথে দেখা ও কথা হল, তিনি আমাকে ইংগিত করে বললেন। আমার ছেলে যদি থাকতো তাহলে তোমার মত এত বড় হতো, আমাকে ভিক্ষা করতে দিত না। আমি বললাম সে কোথায় থাকে? তিনি বললেন হারিয়ে গেছে, জানি না কোথায় আছে। কত পথ প্রান্তরে খোঁজা খুঁজি করেছি পাইনি তবে মনে বিশ্বাস আছে বাজানরে আমার বুকে ফিরে পাবো। আমি বললাম, আপনার ছেলেকে এতো দিনে দেখলে চিনবেন? তিনি বললেন, চিনবোনা মানে সে তো তোমার মত।
আমেনা বেগমের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বশির না দেখার আগেই তা নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে নিলেন। বাবলু বাড়িতে নেই। আজ বাড়ি ফিরবে। তার এক বন্ধুর বিয়েতে গেছে। বশিরকে যেতে বলেছিল, যায় নি। বশির খাওয়া শেষ করে তার নিজের ঘরে চলে গেল। আমেনা বেগম আর খেতে পারলেন না। বুকটা কেমন যেন করছে ! মায়ের মনে সন্দেহ, ছেলেকে হারানোর ভয় জেগেছে।
আমেনা বেগম জানেন বশির তার পেটে ধরা সন্তান নয়, নিজের সন্তান না হলেও এতোটুকু অবহেলা কিংবা বকাঝকা করেননি বশিরকে, যেটুকু বাবলুকে করেছেন।
আমেনা বেগমের মনে শান্তি নেই। তাঁর ভাবনা শুধু বশিরকে নিয়ে, ও যদি জানতে চায় যে, সে নিজে দুই বছর আগে কোথায় ছিল ! তখন উত্তর দিব ! তিনি নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করলেন তাতে কোন সমাধান খুঁজে পেলেন না। শুধু বুকটা হাহাকার করছে। বশিরকে পেটে ধরা ছাড়া আর কী করিনি ! খাওয়ার পর নিজের আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিয়েছি, কোন অসুখ হলে সারারাত জেগে সেবা করেছি, এই বলে আমেনা বেগম আত্মনাদ করছেন। গত দুই বছরের সব স্মৃতি আমেনা বেগমকে তাড়া করছে।
পাশের ঘর থেকে বশির এসে বলল, মা একটা কথা বলব?
আমেনা বেগমের বুকটা নাড়া দিয়ে উঠলো। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে জানতে চাইলেন কি বলবি বাবা বল?
মা তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা তিনজন একত্রে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যেতে চাই। শুনেছি জায়গাটা খুব সুন্দর। সাগরের ঢেউ, সূর্য ডুবার দৃশ্য, জোয়ার ভাটা আর কত কী !
ঠিক আছে তাহলে আমরা আগামীকাল রাত দশটার ট্রেনে রওনা হবো।
বাবলু তো খুশিতে আত্মহারা, এই প্রথম সমুদ্রের ঢেউ দেখবে, শামুকের মালা, লোনা পানি ইত্যাদি। আমেনা বেগমের যাওয়ার তেমন কোন ইচ্ছা ছিল না, তবুও বশির যেহেতু ইচ্ছা প্রকাশ করেছে সেই কারণে যাওয়া।
শীতকাল। কাপড় চোপর নিয়ে রাত দশটার ট্রেনে রওনা হল। হিম বায়ুতে ট্রেন ঝনঝন শব্দে চলছে। বশিরের এই সময় কার কথা যেন মনে পড়ছে। কে যেন অনেক বার সমুদ্র সৈকত দেখতে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। তার নামটা মনে আসছেনা। আজ বশির যাচ্ছে হয়তো ভাল লাগবে না কিংবা লাগতেও পারে ! বিভিন্ন্ন কথা বশিরকে জড়িয়ে ধরলো।
ট্রেন স্টেশনে থেমেছে। ওরা তিনজন ট্রেন থেকে নেমে এক হোটেলে উঠলো। সকালের নান্তা শেষ করে বশিররা সমুদ্র তীরে গেল। কত হাজারে হাজার মানুষ এসেছে সমুদ্র তীরে তাদের আপন কাছের মানুষকে নিয়ে। কিন্তু বশির একাকি দাঁড়িয়ে ঢেউগুলোর দিকে তাঁকিয়ে আছে। যদিও ওর মা ও ভাই সাথে এসেছে তবুও ভালো লাগছেনা।
বশিরের মন আজ ঢেউগুলোর সাথে মিশে যেতে চায় দূর মহনায়, যেখানে শুধু প্রেমের বন্দর, নেই রিক্ততা, কোন হতাশা। কোন বিরহের সুর নেই। বশির একটি বড় পাথরের ওপর বসে আছে। হঠাৎ ভাবনায় একটি কবিতা লিখে ফেললো সমুদ্রের ঢেউকে উদ্দেশ্য করে---
ঢেউ তুমি ঢেউয়ের মত
                       আমার মত নও  তো,
 আমার মত আমার প্রিয়া 
                                                                              তুমি তা জানো তো ।
দুপুরের খাবার শেষ করে আবার সমুদ্রের ঢেউ দেখতে গেল ওরা। তারপর হিমছড়ি চললো। ঝরনার পাড়ে দাঁড়িয়ে বশির এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে তার কলকল শব্দ শুনতে পেল।
সন্ধার আগে ওরা তিনজন হোটেলে ফিরলো। রাত নয়টার ট্রেনে ফিরতে হবে। যে সার্ট ও প্যান্ট পড়ে জলে নেমেছিল তা লোনায় দাগ হয়ে গেছে। সার্টের পকেটে লবন ভরে গেছে। কিছু হালকা খাবার খেয়ে নিল তিন জন। এই সমুদ্র সৈকত বিদায় দিয়ে বশিরের কিছুতেই যেতে মন চাইছে না। এই সৈকতের মাঝে বশির একজনকে খুঁজে পেয়েছিল অদৃশ্য আবেশে। কিছুটা সুখের পরশ উঁকি দিয়েছিল। এই সামান্য সময় বশিরের হৃদয়ে গাঁথা থাকবে।
জানালা বেয়ে বাহিরের দিকে তাঁকিয়ে আছে বশির। মনে হয় গাছপালা বাড়িঘর সব পিছনে পালিয়ে যাচ্ছে। বশিরের মনকে তা দোলা দিচ্ছে। আমেনা বেগম, বাবলু ও বশির একই লাইনের সিটে বসে আছে। এগারোটার দিকে বাবলু ও মা ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু বশিরের চোখে ঘুম আসছে না। তার চোখে শুধু সমুদ্র সৈকতের ঢেউগুলো ভাসছে আর তার কথা মনে পড়ছে। বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বশিরও ঘুমিয়ে  পড়ে। 
ট্রেন কুমিল্লার কাছাকাছি। পাঁচ ছয়জন মুখোশধারি লোক বশির ও বাবলুর বুকে পিস্তল ধরে বলল, টাকা পয়সা সোনা দানা কাপড় চোপড়  যা আছে সব দিয়ে দে নয়তো ফুটা করে দিব।
আমেনা বেগম ডাকাতদের পায়ে ধরে বলেন, দয়া করে আমাদের যা কিছু আছে সব নিয়ে যান তবুও আমার বাজানদের মারবেন না। বশির ডাকাতদের সাথে একটু জোর করায় মাথায় একটু আঘাত লাগে তাতে ও অজ্ঞান হয়ে যায় । সামনের স্টেশনে ট্রেন থামলো বশিরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। এত রাতে কী আর রোগী ভর্তি করা যায় ! তবু অনুরুধ করে ভর্তি করা হল। সেদিন আর বাসায় ফেরা হল না। রক্তে বশিরের দেহ ভিজে গেছে। ডাক্তার বললেন, মাথায় আঘাতটা একটু বেশী লেগেছে ব্রেনের ওপর চাপ পড়েছে, বলা যায় না কী হবে। আল্লাহকে ডাকেন।
এই অচেনা এলাকায় বাবলু ও আমেনা বেগম অন্থির হয়ে পড়লেন, কোন চেনা জানা নেই। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ বশির চোখ খুঁললো কিন্তু কোন কথা বলছে না। শুধু মা আমেনা বেগম ও বাবলুর দিকে তাঁকিয়ে আছে।
বশির বিছানায় শুয়ে আছে, আমেনা বেগম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কেমন লাগছে? গতকাল রাতে ট্রেনে আমাদের ওপর ডাকাতরা আক্রমণ করেছিল তখন তুই মাথায় আঘাত পেয়েছিলি আর এই হাসপাতালে এনেছি।
আমি কেন ট্রেনে যাবো, আমি তো আপনাদের চিনি না। আপনারা কে? আমার নন্দিনি কোথায় যাকে নিয়ে আমি পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যাই।
আমেনা বেগম অবাক হয়ে বশিরের পানে তাঁকিয়ে রইলেন। বললেন, বাবা বশির আমি তোর মা আর বাবলু তোর ছোট ভাই। আমাদেরকে চিনতে পারছিস না?
কি আবোল তাবোল কথা বলছেন। আপনারা কেন আমার মা ও ভাই হবেন? আমার মায়ের নাম মনিকা বাপের নাম করিম শেখ আর আমার একমাত্র বোন চাপা।
 আমেনা বেগম ডাক্তারকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন, একি হয়ে গেল, আমার ছেলে আমাকে চিনতে পারছে না। বাবলুকেও অস্বীকার করছে।
ডাক্তার বললেন; একটি সত্যি কথার উত্তর দিন। বশির কি আপনার পেটে ধরা সন্তান নাকি পালিত সন্তান?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমেনা বেগম বলেন, বশির আমার পেটে ধরা সন্তান না হলেও নিজের সন্তানের মত স্নেহ মমতা দিয়ে বুকের মাঝে আগলে রেখেছি। কখনও বুঝতে দেইনি দুঃখ কষ্ট কাকে বলে। আর সেই সন্তান যদি আমাকে অস্বীকার করে তাহলে কেমনে বাঁচবো, বলেন ডাক্তার সাহেব?
ওদিকে বশির বলছে, আমি বাবা মার কাছে যাবো, আপনাদের সাথে যাবো না। আমেনা বেগম কাছে গিয়ে বললেন, আগে আমাদের বাসায় চলো তারপর ঠিকানা জেনে তোমাকে তোমার বাবা মা’র কাছে পৌচ্ছে দিব।
ওরা তিনজন গাড়ি চড়ে প্রায় বিকাল চারটার সময় বাসায় ফিরলো। আমেনা বেগমের মনে কোন শান্তি নেই শুধু ফুপিয়ে কাঁদছেন কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেন না। বশিরকে তার ঘরে নিয়ে বললেন, মনে করে দেখো তো বশির এই ঘরে তুমি থাকতে গান গাইতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। এসব মনে করার চেষ্টা করো !
অন্য কী ঘটেছে আমি জানি না, শুধু আমার চোখের সামনে ভাসছে মা বাবা আমাকে ডেকে বলছেন, ওরে খোকা আমার বুকে আয়। এক মাত্র বোন চাপা, তার মুখ থেকে কতদিন যেন ভাইয়া ডাক শুনিনা। আমি তাদের কাছে যাবো আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন। আচ্ছা আপনাদের সংসারে আমার আগমন কতদিন ধরে?
মা আমেনা বেগম একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল। গত দুই বৎসর যাবৎ তুমি আমাদের সাথে আছ। এর মাঝে কোনদিন তোমার বাবা মা বোনের কথা তুমি বলোনি। তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও তুমি তখন বলতে পারোনি, শুধু কেঁদেছো। আমার ইচ্ছায় তোমায় আমার সন্তানের মত লালন পালন করেছি।  তারপর তোমাকে ক্লাস নাইনে ভর্তি করে দিলাম এ বছর তুমি ক্লাস টেনে।
আমি তো এস এস সি পাস করেছি। যাক- আমাকে যেহেতু আপনি ছেলের মত আদর দিয়ে স্নেহ দিয়ে বুকে ধরে রেখেছেন, সেহেতু আপনি আমার মা। মা আমাকে বলুন, আমাকে কিভাবে খুঁজে পেলেন?
সেদিন আমি আমার এক মাত্র সন্তান বাবলুকে নিয়ে আমার এক আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলাম। প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। চারদিকে অন্ধকার, আকাশটা মেঘে ভরা, মেঘের গর্জন মাটি কাঁপিয়ে তুলছিল। তবুও পথ দিয়ে হাঁটছি। হাতে ছিল টর্চ লাইট। হঠাৎ কাছেই পথের ধারে একটা মানুষ পড়ে থাকতে দেখি। রক্ত মাখা মুখ, রক্তে সারা শরীর ভিজে গেছে। মাথায় ক্ষত দাগের চিহ্ন। কনকনে শীতে কাঁপছে। আমি আর বাবলু তাকে তাড়াতাড়ি তুলে মূল পথে নিয়ে এলাম। অনেক কষ্টে একটা ভ্যানে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বললেন, অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে, রক্ত দিতে হবে। ভাগ্য গুণে ঐ হাসপাতালে রক্ত পেয়ে গেলাম। পরের দিন সকাল দশটায় ছেলেটির জ্ঞান ফিরলো। আর আত্মীয় বাড়িতে যাওয়া হল না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম তোমার নাম কি? তোমার বাড়ি কোথায়? কে কে আছে তোমার?
কোন উত্তরই দিতে পারল না। শুধু কাঁদতে থাকে। আর সেই থেকে তাকে আমাদের মাঝে রেখে দিলাম। তুমিই হলে সেই বশির। আর কখনও জানতে চাইনি তোমার পরিচয়। নিজের সন্তান বাবলুর সাথে তোমাকেও আদর স্নেহ ভালবাসা দিয়ে বুকে আগলে রেখেছি। কখনও বুঝতে দেইনি তুমি আমার সন্তান না। আজ আমার বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে কেমনে তোমাকে বিদায় দিব? আচ্ছা বশির তোর পুরানো জীবন সম্পর্কে সব মনে আছে?
জি সব মনে আছে। আপনাকে সব বলব যদি শুনতে চান।
তাহলে বল..
                                                               সমাপ্ত                                     
কবি ও কবিতা

কবি ও কবিতা

রক্তিম ফুলে ভেজা তোমার
অবাক করা দু-খানি চাহনি,
ভুলি নাই আমি ভুলি নাই
কখনো ভুলতে পারিনি।

সন্ধা আকাশের বুকে তুমি আমার
লক্ষ তারার মাঝে একটি চাঁদ,
তুমি আমার বুকের মধ্যেখানে-
থাকো, তোমার চলা অবাধ।

শত রিক্ততা শত ব্যর্থতার মাঝে
কষ্টগুলো আমায় পুড়ায়,
তোমার মাঝে ডুবেছি তবু পাইনা-
কেন, এ হিয়া তলায়।

আকাশের কথা আমার ব্যাথা
একই পথের পথিক,
শূন্য হৃদয় আমার, তোমায় চায়
কখনো দিওনা মনে ধিক।

একা ছিলাম তোমার দেখায় পেয়েছিলুম
সাত সাগরের মহনা,
ফুলশয্যা মরে গেছে চৈত্রের খরায়
তাই আমি আপনার না।

কিছু স্বপ্ন আশায় থাকে
পাওয়া না পাওয়ার গল্প,
হয়তো আমি হারিয়েছি সব
পেয়েছিলাম যে অল্প।
                                                              তারিখ ও সময়:- ২৭/০৬/২০০৫, ১৩-৫০

কবি ও কবিতা

আমি তোমাকে চাই সাঁঝ বেলাতে
যখন গোধূলীর লগ্নে উল্টো আকাশে
মূদু হাওয়া বইতে থাকে,
আর তখন আকাশের তারাগুলো
ক্লান্ত দিন শেষে উদ্ধিপনায় জাগে-
নব স্বর্ন শিহরে।

আমি তোমাকে চাই গভীর রজনীতে
নেই কোন কোলাহল
থাকবেনা কোন স্বার্থযুক্ত চাহিদা।
শুধু তুমি আমি দু-জনা
দুটি মন একই মহনা।
গাইবো গান মন বদলের
আর হারিয়ে যাবো দূর গগণে।

আমি তোমাকে চাই শেষ বিকেলে,
সৃর্যটা ধীরে ধীরে আলোহীন
আর হিমেল হাওয়া বইবে।
কিছু দূরে পাশাপাশি থাকবো-
মনের কথা কইবো
জীবনের তরী ভাসাবো
আর তুমি বৈঠা বইবে
শিশির ভেজা ঘাসের উপর ।

আমি তোমাকে চাই ফুল রুপে,
হৃদয়ের জমিনে মালা গাঁথবো
আর সারি সারিতে ঝুলিয়ে রাখবো
মৌ মৌ গন্ধ ছড়াবে,
কিন্তু মধুর খোঁজ পাবেনা
ভ্রমরগুলো ব্যর্থ ছুটাছুটি করবে !
কারণ, তুমি থাকবে হৃদয়ে বন্দি।

আমি তোমাকে চাই রিমিঝিমি বৃষ্টিতে,
বৈশাখি ঝড়ের প্লাবনে মিশে-
দু-জন মিলে সাঁতার কাটাতে,
আর দূর নদীতে পানকৌড়িগুলো-
জলের সমারহে খেলবে,
তোমার দেহখানি ভিজে যাবে
আমার পানে অপলকে থাকবে।

আমি তোমাকে চাই খর তাপের বেলায়,
সময়টায় তৃষ্ণা লাগে
বুকটা চৌচির হয়ে যায়,
তুমি পাশে থাকিলে, তাহা শিহরন
আমার দেহখানি সতেজ হবে।

আমি তোমাকে চাই দখিন হাওয়ার মাঝে
সর্ব দেহের ক্লানি- যেন নিঃশেষ হয়,
উদিত হয় সুভাসিত লগ্ন।
আমার দেহ খানি নব সাঁজে-
চির সবুজ অরণ্যে ভরে যাবে।
তুমি এসো, এই হৃদয়ে
ভালবাসার বন্ধন মায়ায়,
কোন তর্কে নয় প্রেমের-
পূস্পমেলা মাতাল হাওয়ায়।
                                                            তারিখ ও সময়:- ১১/০৭/২০০৫, ০৯-৫০

sislam8405

{Facebook#https://www.facebook.com}

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget