সাদাকালো ।। Shadakalo ।। বাংলা উপন্যাস ।। Bangla Novel ।। দ্বিতীয় পার্ট

(দ্বিতীয় পর্ব)   
    মাস না যেতেই আজিম আবার জমসেরের বাড়িতে আসেন। আজ সাথে তাঁর বউ এসেছেন। আজিমের বউ শামুর ঘরে গিয়ে পান চিবুচ্ছেন। বানুকে বললেন, "ওদের প্রতি বেশী জোর দেওয়া যাবে না। যদি হঠাৎ করে বলে কালুকে বিদেশ নিতে পারব না। তখন কিন্তু আমরা বলেও কিছু করতে পারব না।" কালু পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। তার সামনের দুটো দাঁত নেই। মুখ থেকে ছেব(থুঁ থুঁ) বের করার ইচ্ছে হলে হা করার দরকার পড়ে না। দাঁতের ফাঁক দিয়েই বের হয়ে আসে। কালুর দাঁতের মত নাহারের দাঁতের ধরনও একই। তবে আরেক বোন শিখার দাঁত অমন না। কালু দাঁত বের করে আজিমের বউকে বলল, "দাদি যে করেই হোক চাচিকে বলে আমার বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। দেশে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগেনা। যদি আপনার কথা চাচি না শুনে তবে কিন্তু চাচিকে...।" বানু মুখ এগিয়ে দিয়ে কালুকে বলল, "কি করবি ? দেখ ! কথা কিন্তু বুঝে বলিস। সে তোর চাচি, মায়ের মত।"
    -মা তো আর না।
    -এবার হবে। গতকাল লতাকে বলেছি, যদি কালুকে না নেয় তবে জমসেরের ভাগে বাড়ির জমি যে টুকু পড়ে তা বিক্রয় করে কালুকে বিদেশ পাঠাবো। অন্য সময় বিভিন্ন জবাব দিলেও কাল দেয়নি। মনে হয় ভয় পেয়েছে। এতোক্ষণে হয়তো জমসেরের কাছে খবর চলে গেছে। শামু কই ?
    -বাবা তো বাড়িতেই ছিল, হয়তো আপনাদের বাড়ির দিকেই গেছেন। কি করবে, কোন কিছু স্থির করতে পারছেন না।     আজিম ও তাঁর বউ হোসেনের উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হোসেন হাসেমকে বলল, "চেয়ারটা বের করে দে তো।" হাসেম ঘরেই পাঠ্য বই পড়তেছিল। বলল, "চেয়ারে তো চালের ছালা রাখা হয়েছে।" আজিম বাহির থেকে বললেন, "চেয়ার লাগবেনা। আসল কথা শুনতে এসেছি। এই হোসেন তোর বাপে কি আরও কিছু বলেছে ?" হোসেন আগে আজিমকে অনেক ভয় পেলেও এখন কিছুটা কমে এসেছে। আজিমের ধমকের পরিবর্তে জবাব না দিলেও ভাবে, শালার শুয়রের বাচ্চা মারা যাবেন কবে ! কবে স্রষ্টা তাঁকে কবরে পাঠাবে ! সেদিন দুধ দিয়ে গোছল করতাম। হোসেন বলল, "বাবার সাথে আমার আর কথা হয়নি। মার সাথে হয়েছে কিনা জানি না।"
    লতা কাদা আনতে খালের পাড়ে গিয়েছিল, কাদার ঝুড়িটা রেখে মুখ ঘুরিয়ে লতা কাদা লাগা হাতদ্বয় ধুয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আজিম বললেন, "কালুর ব্যাপারে কিছু হল ?"
    -বলেছিলাম, উত্তরে বলেছে চেষ্টা করতেছি।
    -চেষ্টা, চেষ্টা আর কতদিন হবে। বছর চারটা চলে যাচ্ছে। কালুকে বিদেশ নেওয়ার কোন নাম গন্ধও তো নেই। দেখো বেটি, আমার রাগটা কিন্তু তুমি জানো।
    -মাথাটা আপনার, আর তা খারাপ হলে আমার কিছু যায় আসে না। আপনি বলতে বলেছিলেন আমি বলেছি। যা করার হোসেনের বাপ করবে, আপনি তাঁকে বলতে পারেন না ? মেয়ে মানুষের কাছে এসে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করেন ! এই বাড়িতে এসে জোর দেখান, মেরে ফেলার ভয় দেখান। আমিও কম না। জমসেরের কাছে বিয়ে হয়েছে বলেই আমি দূর্বল না। আমার ভাই একজন আর্মির সৈনিক। তাকে যদি বলি আপনি আমাকে কিছু করার ভয় দেখিয়েছেন। তবে আপনার গলায় ছাগলের দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাবে।
    হোসেন লতাকে বলল, "মা ! দাদাকে একি বলছেন ?"
    বানুর গলা বাড়িয়ে এসে আজিমকে বলছেন, "দেখলেন মামা, কি দাজ্জাল মহিলা ! বিদেশি টাকার ভাত খেয়ে কি জোর হয়েছে ! ঐ জোর বেশীদিন থাকবে না। খোদায় সহ্য করবেন না। আমার পোলাকে যে নিরাশ করতেছে খোদা তাকে ফকির বানিয়ে ছাড়বেন।"
    -বানালে বানাবে তাই তোর কাছে যাবো ? লতা একটু এগিয়ে গিয়ে বলতেছে।
    -যাবি কেন আগেই তো সব শেষ করে দিয়েছিস। আমাদেরকে পথের ফকির বানিয়েছিস। শাশুড়ি জমিন বিক্রয় করে না দিলে যেতে পারতো।
    -এক কথা বারবার বলার কি দরকার। আমি কি জমিনের কথা অস্বীকার করেছি ! হোসেনের বাপকে তো বলতেছি তারাতাড়ি ভিসা করার জন্য। যদি না করতে পারে তাহলে কি আমি গিয়ে করবো ?
    আজিম এতোক্ষণ ধরে বানু ও লতার ঝগড়া দেখছিলেন। আর কোন কথা না বলে নিজের বউকে নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। হোসেন ঘরের ভিতরে গিয়ে বসে আছে, পাশেই তার মা দাঁড়িয়ে আছে। হোসেন বলল, মা ! একটু তো উনারা বলবেই। তা মনে করে চিন্তা করো না। ওদের বেলায় আমরাও বলতাম। তাই কিছূ সহ্য করতে হবে। লতা বলল, ওরা যদি বলে তবে না হয় সহ্য করলাম কিন্তু পর মানুষ এসে কথা বলে যাবে কেন ?  ওদেরটা খেয়ে থাকি নাকি ?

shadakalo

    হাসেম স্কুলে গেল। তন্নি এখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। সে সারাদিন ওর বয়সি মেয়েদের সাথে খেলা করে। হাসেমও হোসেনের মত কিছু ভাবে। আজিমকে মরার চিনত্মা করে। ওরা ছোট মানুষ, বিভিন্ন ভাবনা হতে পারে ! তাই বলে তা কখনো করা ঠিক না।    
    জমসেরের বাপের বংশধর দমতল গ্রামের। ওর বাপকে জমসেরের নানা নিজের মেয়ে সাথে বিয়ে দিয়ে পূবহাটিতে ঘর জামাই হিসেবে রেখে দেন। জমসেরের নানার কোন ছেলে ছিল না। দুটো মাত্র মেয়ে। ছেলে না থাকার কারণে সেই সুযোগে আগেই ভাতিজারা চালাকি করে বিভিন্ন ভাবে জমসেরের নানার সম্পত্তি কাগজে কলমে জাল দলিল করে নিয়ে নেন, কিন্তু তখন দখলে যান নি। ওর নানাও বেঁচে থাকতে তা জানেন নি। কিছু জমি জমসেরের মায়ের নামে লিখে দিয়ে যান। যা তাঁরা নিতে পারেন নি। ভাতিজারা সবাই জমসেরের মায়ের চাচাতো ভাই। তাঁর মধ্যে একজন বেশী নিয়েছেন। তিনি মুফিত। নামে মোল্লা। তিনি এ সমাজের মসজিদের ইমাম। দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর ধরে ইমামতি করেছেন। বর্তমানে পাশেই অন্য সমাজের একটা মসজিদে বেতনভূক্ত ইমাম। তাঁর পাঞ্জাবির প্রতিটা সূতার গায়ে গায়ে পাঁপ লেগে আছে। পাঞ্জাবির পকেটে সাতটা দোযক ভরে রেখেছেন। নামাজ পড়ানোর সময়ও তাঁর ধ্যান চলে যায় কোথায় খাস জমি পড়ে আছে। তা কিভাবে দখল করা যাবে। সেই সমাধান নামাজ পড়ানো মধ্যেই সম্পূর্ণ হয়।
    শামু ও জমসেরের পরিবারের সবাই মুফিতকে প্রতিটা নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে অভিষাপ দেয়। এমন কাজের লোকদের অভিষাপ দিতে হয় না। স্রষ্টা তো আর ঘুমিয়ে থাকেন না, তিনি সবই দেখছেন। কার কি পাপ্প এই দুনিয়ার জমিনে কিংবা পরপারে তিনি তা পাই পাই করে দিবেন।
    এক বাপের এক পোলা মুফিত। বোন চারজন। হিসেব করে দেখেন, বাপের সম্পত্তির তেত্রিশ ভাগ বাদে সবই বোনেরা পান। মুফিতের মাথা খারাপ হয়ে যায়। ভাবেন, কি করা যায় ! মুফিতের মা বেঁচে আছেন, তিনি স্বামীর সব অংশের দু-আনা পান। অথাৎ আট ভাগের এক ভাগ। ওতেই অনেক জমি হয়। একদিন মুফিত তাঁর মাকে বললেন, "মা ! বোনেরা তো এমনিতেই বাপের সম্পত্তির অনেক পাবে। তোমার ভাগটা না হয় আমার বড় ছেলে লাবুকে দেও।" এমন কথা শুনে ওর মা আর কোন জবাব দেন নি। নীরবতা সম্মতির আংশিক লক্ষণ ভেবে। মুকিত দু-দিনেই দলিল বানিয়ে মাকে রেজিষ্টি অফিসে নিয়ে অল্প জমিনের কথা বলে সবগুলো দাগে যে জমি পাবেন সব জমি লিখে নেন। মুফিতের এক চিন্তা ফুরালো। এখন কিভাবে বোনদের ভাগ নেওয়া যাবে সেই ভাবনায় নেমেছেন। মনে হয় না বোনদের ভাগের কিছু করতে পারবেন ! তবে বোনদের বলে অর্ধেক টাকায় লিখে নেওয়ার প্রসত্মাব করতে পারেন। মুফিত জমসেরের মায়ের আপন চাচাতো ভাই। আর অন্য সবাই চাচাতোর চাচাতো ভাই।
    জমসের জমি সম্পর্কে কিছু বুঝে না। সাবেক দাগ, হাল দাগ, মৌজা, খতিয়ান, রেকর্ড কাগজ ইত্যাদিও কিছুই বুঝে না। নানার যে বিশাল সম্পত্তি ছিল, তার কাগজ পত্র অবশ্যই কম ছিলনা ! কিন্তু জমসের কিংবা শামুর ঘরে তার কোন কাগজই নেই। কাগজ কোথায় গেল ? মুফিতের কাছে আছে। মুফিতের কাছে থাকবে কেন ? এই কথাটাই বলে কে !
    হোসেন তখন খুবই ছোট, জমসেরও বিদেশ যায়নি। মুফিত গিয়ে জমসেরকে বলতো, "তোমার ঘরে জমির কোন কাগজ পত্র আছে ?" জমসের বলে, "ভাঙ্গা বাক্স এ তো অনেক দেখেছিলাম। আচ্ছা উঠোনে পাটি বিছিয়ে দিচ্ছি যা দরকার হয় নিয়ে যান।"  জমসের লতাকে বলে, "বাক্সটা বের করে দাও তো। মামার যেন কি কাগজের দরকার !"  লতাও তখন নতুন বউয়ের মত। সেও জমির ব্যাপারে কিছু বুঝে না। মুফিত আপন মনে দেখে দেখে তাঁর প্রয়োজনিয় কাগজপত্র নিয়ে যেতেন। এভাবে মুফিত মাঝে মাঝে ঐ কাগজ নিয়ে যেতেন আর ফেরত দিতেন না। ওদের দু-ভাইয়ের ঘরে জমির কোন কাগজই নেই। কাগজ থাকবে কেমনে ! জমিনই তো নেই। নানার সম্পতির যদি অর্ধেকও জমসের ও শামু পেতেন তবে ওদের জীবন জীবিকার জন্য এতো কষ্ট করতে হতো না।
    মাটি জিনিস বড় খাঁটি এর মাঝে কোন বেজাল নেই। হয়তো কেউ তা নিয়ে অগোছালো খেলা খেলে। যে খেলে তাঁর কি গতি হবে স্রষ্টাই ভালো জানেন ! মাত্র সারে তিন হাত মাটির নিচে শুতে হবে। কি হবে এতো জমি দিয়ে কি হবে জমির কাগজ দিয়ে !
    জমসেরের মা কিছুটা মানসিক সমস্যায় ভুগেন। সারাদিন শুধু কথা বলতেই থাকেন। কে শুনছে না শুনছে তা ভেবে তবুও থামার নাম নেই। মাথায় একটা বাড়তি কাপড় পেঁচিয়ে মাথা বেঁধে রাখেন। বাড়ি বাড়ি বলে বেড়ান, এর কথা তার কাছে, তার কথা এর কাছে ইত্যাদি। হোসেন বলে বু (দাদী) ! তুমি খাও আমাদের ঘরে অথচ বাড়ি বাড়ি আমার মায়ের দুর্নাম গাও তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলো তা কি ঠিক হয় ? কালও না আজিম দাদার কাছে গিয়ে বললে, "আমাকে শুধূ আলু ভর্তা দিয়ে ভাত দেয়।" তিনি বললেন, "ওরা কি দিয়ে খায় !" তুমি বললে, "তারাও আলু ভর্তা দিয়ে খায়।" দাদা বললেন, "তাহলে তো তাই দিবে।" এমন কথা বলে নিজের মান কেন কমাও ? যা স্রষ্টায় জোটায়ে দেন তারই একটা অংশ তোমাকেও খেতে দেন। এখন থেকে অমন কথা অন্যকে বলো না। হোসেন দাদীকে বুঝিয়ে অনেক কথা বলে কোন উন্নতি হয় না। আজ শুনলে কাল সকালে গিয়েই আবার জোবেরের কাছে গিয়ে অমনটা ভিন্ন ভাষায় বলবেন। পরশু ইয়ামিনের কাছে গিয়ে বলবেন। দাদী একমাত্র ইয়ামিনকে ভাই বলে ডাকেন। আর তো সবাই ছোট।

    জমসেরের বাবা লোকটা নাকি কিছু সহজ সরল ছিলেন। যেমন লম্বা তেমন সুন্দর। তিনি তাঁর ছেলে মনু মরার এক দেড় বৎসর পরে মারা যান। তখন শামু বিয়ে করলেও জমসের বিয়ে করেনি। মনু মারা যায় সাপের কামড়ে। সেদিন বিকেল গড়িয়ে যায় অথচ মনু বাড়ি ফিরে না। কোথায় গেল ! মায়ের মন উতালা হয়ে যায়। জমসেরকে বলেন, "দেখতো বাবা শামুক কুড়াতে গিয়ে মনু আবার কোথায় গেল !" মনুর তো কোন কাজের ঠিক ঠিকানা নেই। মাছ ধরতে গেলে তা বাদ দিয়ে শাপলা ও ঢেপ কুড়িয়ে নিয়ে আসবে। কাজ করতে পাঠালে লুঙ্গিতে কাদা লাগিয়ে দুটো পুঁটি মাছ ধরে নিয়ে আসবে। সেদিন কোথায় কি কাজে গেছে সঠিক ভাবে কেউ জানেন না। সন্ধ্যার পর মনুর খবর পাওয়া গেল। কালা ঘাটের (খালের নাম) দক্ষিণ ধারে একটা মানুষের লাশ ভাসতেছে। জমসের এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে যায়।
    শামু ঘরে বসে বিড়ি টানছেন। ওর বউ বানু বলেন, "ঘরেই বসে থাকবে ! একটু মনুর খুঁজে যাওনা। আম্মা সেই যে কাঁদছেন।" শামু বলেন, "জমসের না কোথায় যেন খুঁজতে গেল ?" বানু বলল, "সে গেছে তাতে কি হয়েছে ! তুমিও যাও। মনু কি তোমার রক্তের ভাই না ! যদি তার খারাপ কিছু হয় তবে কথা বলার জায়গা পাবে না কিন'।"
    শামু বিড়ির অর্ধেক ফেলেই ঘরের বাহিরে যান। পায়ের ও হাতের নখগুলো দুই ইঞ্চি বড় গেছে, কাটার নাম নেই। কোন ব্লেড দিয়ে শামুর হাত ও পায়ের নখ কাটা যায় না। বাপরে বাপ শক্ত ! পানিতে নেমে কোন কাজ করার পর নখ নরম হলে তবেই ধারালো দা দিয়ে কাটতে হয়। শামু ঘরের দরজার পার হতেই এক কান্ড ঘটে গেল। দরজার কাঠের ফ্রেমের নিচেরটার সাথে ডান পায়ের বড় আঙ্গুলের হোঁচট লেগে তা রক্তাক্ত হয়ে যায়। এবার নখ আর কাটতে হবে না। এমনিতেই উঠে গেছে। শামু চিৎকার করতেই, বানু ঘর থেকে বের হয়ে বলল, আবার কি হল ! ও এই দশা  ! ঠিকই হয়েছে। নিজের ভাইকে না খুঁজে ঘরে বসে থাকার শাস্তি দেখো। মানুষ সহ্য করলেও স্রষ্টা সহ্য করেন না। বানু কথা বলছেন আর ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো দিয়ে রক্তাক্ত অংশটায় বাঁধ দিচ্ছেন। টুকরো কাপড়টা হল, যা দিয়ে বানু কালুকে হাগু করানোর পর ধুয়ে পাছা মুছে দেন। হয়তো এখন বানুর তা মনে নেই। বাঁধা শেষ। গুয়ের গন্ধ আসে কোথা থেকে ? শামু বলেন। বানুর মনে পড়ে গেল আসল কথা। ভাবে, এখন যদি ও কথা বলা হয় তবে বাম পায়ের লাথি ছাড়া কিছু জোটবেনা। যদিও বানুকে শামু কোন দিন ধমকও দেয়নি। পুরম্নষের রাগ কখন উঠে বলা মুশকিল। তবুও বানু বলেন, "তুমি না একটু আগে অমন কাজ সেরে এলে, আবার তোমার লুঙ্গিতে লেগে রয় নি তো !" শামু নিজের হাত পাছার দিকে দিযে দেখলো ভেজা নেই। শামুকে শুয়ে দেওয়া হল।
    জমসের বাড়ির দিকে আসছে। সাথে হাজারো লোকের জোটলা। মনুর কিছু না হলে এতো মানুষের জোটলা হতো না। মনুর সারা শরীর নীল হয়ে গেছে। কি মায়াবি মুখটা আজ নীরব। আজ মনু কোন কথা বলবে না। সে আজ রাগে কারো গাছের নারিকেল গাছওয়ালাকে না বলে পেড়ে আনবে না। সে মারা গেছে। আয় বাবা আমার বুকে ফিরে আয়, এমন আত্মনাদ মনুর মা তাকে বুকে টেনে নিয়ে করছেন।
    শামু কেমনে এতো খাটাশ হলেন ! তিনি পায়ের ব্যাথা বিছানায় শুয়ে আছেন। রাত দশটার মধ্যে বোনেরা সবাই ইতিমধ্যে এসে গেছেন। পরের দিন দুপুরে মনুর লাশ কবরে রাখা হল। 

    মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুলে ভরা জমসের তার মেঝ বোনের জামাই বাড়ি বেড়াতে যান। সেখানেই লতার সাথে প্রথম পরিচয় হয়। লতা ভাষায় জমসের অসম্ভব ধরনের হাসির লোক, আড্ডা জমাতে পারে। যে কোন আসর মজিয়ে তুলতে পারে। লতার বাড়ির পাশ দিয়েই জমসের বোনের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাজার করে দিতো। ওখানের গাঙ্গে নেমে মাছ ধরতো। কখনও গরুর জন্য ঘাস কেটে দিয়ে দুলাভাইয়ের কাজ এগিয়ে দিতো। বিনিময়ে জমসেরের আবদার ছিল দুলাভাইয়ের প্রতি, দিনে দশ টাকা করে দিতে হবে। তাই পেতো।
    একদিন হঠাৎ করেই লতার সাথে জমসের বিয়ে হয়ে যায়। লতার বাপের বাড়ির লোকদের নিজের গ্রামে অনেক নাম ডাক আছে। এক নামে সবাই জানেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে একজন সম্পূর্ণভাবে সংসার নিয়ে ব্যসত্ম আরেকজন চাকুরি করে পরেরজন কিছু পড়ে বাদ দেয়।  জমসেরের সংসারে বড়ই অভাব। সকালের খাবার হলে দুপুরেরটা অজানা। কিছু জোটবে কিনা কেউ জানে না। তখনও হাসেম ও তন্নির জন্ম হয়নি। হোসেনের বয়স অল্প। শামু তাঁর পরিবার নিয়ে আলাদা হয়েছেন। জমসেরের ভাগে বোন ভাগনে ও মা পড়েছে। ওদের কাউকে মনের ভূলেও শামু একবেলা খাওয়ান না। শামুর বউটা অসম্ভব ধরনের ঝগড়াটে। ঝগড়ার সময় হাত পা একসাথে লাফালাফি করে। ঝগড়াটা জমসেরের পরিবারের সাথে হয়। তা শুধু কথার মাঝে থাকে না। কখনও লাঁঠি নিয়ে হুমকি ধামকি শুরু হয়। গ্রামের মানুষ সব জড়ো হয়। তাদের বেশীর ভাগই জমসেরের পক্ষে গিয়ে তার উঠোনে দাঁড়ায়।
    শামু বিয়েটা আসলে বানুর সাথে হওয়ার কথা ছিলনা। কেমন করে যেন হয়ে গেল। স্রষ্টার লীলা বুঝা বড় দায়। যে মেয়েকে শামু বিয়ে করার জন্য বর যাত্রী নিয়ে গিয়েছিল সেই মেয়ের সাথে বিয়েটা হয়নি। তার অবশ্য একটা কারণ আছে। কারণটা কতটুকু সত্য জানা নেই তবে যা হয়েছে তা হল। শামু বিয়ের আসরে বসে আছেন। খাওয়ার পর্ব শেষ। মুরুব্বিদের কথা বলার পর্ব হবে। হঠাৎ করেই শামু অবিরাম কাশতে থাকেন। কাশতে কাশতে নিজের চোখ শকুনের মত লাল হয়ে যায়। গলা দিয়ে কিছু রক্ত বের হয়। উপস্থিত বর যাত্রীর সামনে মেয়ের বাপের মত পাল্টে গেল। বললেন, "আমার মেয়েকে এই যক্ষ্মা রুগির সাথে বিয়ে দিব না।"  উপস্থিত বর যাত্রীর অনেকেই বলল, "ইহা কোন রোগ না, ছয় মাসে একবার এমন হয়।" কোন ভাবেই মেয়ের বাপ তাঁর মত পরিবর্তন করলেন না। বিয়ের আসর ভেঙে গেল। বর যাত্রী সবাই বিয়ে বাড়ি থেকে বের হল। তাদের মধ্যের এক মুরম্নব্বি বললেন, "যে করে যেভাবেই হোক বরকে বিয়ে করিয়ে নিতে হবে, নয়তো গ্রামে মান থাকবে না।" সবার ভাবনা, আশেপাশে কি কারো কোন বিধবা কিংবা অবিবাহিত মেয়ে আছে ? যার সাথে শামুর বিয়ের সেরে মান রক্ষা করা যাবে ! স্রষ্টা চাইলে সব হয়। 
    এক টুপিওয়ালা লোক ইশার নামাজ পড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। তাঁর নজর লোকগুলো দিকে পড়তেই এগিয়ে গিয়ে কারণ জানতে চাইলেন ! তিনি সব জানলেন এবং বললেন, "আপনাদের সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে, তবে মেয়েটা কালো খাটো  ও গরিব বাপের সন্তান ।" বর যাত্রীরা বলল, "তাতে কোন সমস্যা নেই। আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করেন।" একঘন্টার ভিতরে বিয়ের কাজ শেষ করে বর যাত্রীরা কনে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলেন। সেই কালো ও খাটো মেয়েটি হল, বানু। কালুর মা।
    বানু কথায় কথায় বলেন, "আমি চারটা ভাইয়ের বোন।" লতার ঝগড়া সময় বলেন, "চারটা ভাইয়ের বোন হয়েছে তাতে কি হয়েছে ! বাড়িতে নেই ঝাল বাক্স, সেই ভাইয়ের গর্ব করে। আমার ভাইও তো তিন জন। আমি তো কখনও বাপের বাড়ি গর্ব করি না। মেয়েদের বিয়ে হলে সকল গর্ব থাকা উচিত স্বামীকে নিয়ে। কিন্তু আপনি করেন ভাইদের নিয়ে।"
    বানুর বাপের বাড়িতে আছে কি ! চার ভাইয়ের চারটা ছনের ঘর। মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকতে হয়। ঘরে কোন জানালা নেই। মাটির দেয়ালের ঘর। একবার গিয়ে বানু কোন দিন দুদিন বাপের বাড়িতে থাকতে পারেন নি। সকালে বাড়ি থেকে খেয়ে গেলে দুপুরে সেখানে জোটলে খান নয়তো না খেয়েই ফিরে এসে সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে খান।
    জমসেরের সাথে শামুর কোন দিনই মিল হল না। ভাইয়ে ভাইয়ে যে টুকু মিল আছে দু্‌-জায়ের মাঝে তাও নেই। সাপ বেজীর ঝগড়া লেগেই থাকে। জমসের পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন। পড়ার ইচ্ছা থাকলেও অভাবের কারণে পড়া হয়নি। বিয়ের আগেই বাবা মারা যাওয়ায় জমসেরের ওপর বোনদের বিয়ে ও সংসারের ভাড় পড়ে। জমসেরের হাতে লেখা খুবই ভালো। তাঁর আশা নিজের তো পড়া হলই না। সন্তানদের পড়ালেখা করাবে। কিন্তু কিভাবে ! অভাব যেন সরতেই চায় না। পরের কাজ করে আর কত মুজুরি পাওয়া যায় ! তা দিয়ে কি সংসার চলে ! মা বউ সন্তান ও নিজের কাপড় চোপড় কিনতে পারেন না। জমসেরকে আজিম তার গায়ের পুরানো সার্ট দেন। কাজ দেন, কাজের বিনিময়ে টাকা ও চাল দেন। লতা বলে, ”আমিও তাহলে পরের বাড়িতে গিয়ে কাজ করি ? কাজকে ছোট করে দেখতে নেই। চুরি তো আর করবো না !" লতার কথা শুনে জমসেরের চোখে পানি এসে যায়। বলে, "আর যদি কোন দিন অমন কথা বলো, আমার মরা মুখ...।" লতা নিজের হাত দিয়ে স্বামীর মুখ চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন।
    লতা ধনী বাপের মেয়ে। সে ইচ্ছে করলে জমসেরের এই অভাবের সংসার ফেলে দিয়ে চলে যেতে পারেন। কিন্তু তা লতা করেননি। তিনি জানেন, স্বামীর ঘরই আসল ঠিকানা। জমসের মুফিতের একটা বড় জমি বর্গা চাষ করেন। সাথে তাঁরও একটু আছে। দু-অংশ মিলে যে ধান পান তাতে তার বছর চলে যাওয়ার কথা কিন্তু যায় না। কারণ ! জমি আবাদ করতে খরচ আছে, সে চরা সুদে টাকা নিয়ে তা আবাদ করেন, ফসল উঠলে সে ধান বিক্রয় করে টাকা শোধ দেন। তাঁর ভাগে শুকনো খড় ছাড়া কিছুই থাকেনা। সেই অভাব অভাবই, তা আর সরে না। বিশ হাজার টাকাও যদি পুঁজি থাকতো তবে যে কোন ব্যবসা করে চলা যেতো। কে দিবে অত টাকা ! জমসেরের চোখ থেকে পানি সরে না। কি লাভ কেঁদে ! আজিমই প্রথম জমসেরকে বলেন, "একটা কাজ করলে কেমন হয় ?"
    -কি কাজ মামা ?
    -তুই বিদেশ চলে যা। আমার এক খালাতো ভাই বিদেশ থাকে, সে ভিসা করে ঐ দেশে লোক নেয়। তুই যদি যেতে চাস তবে বলতে পারি ।
    -কিন্তু এতো টাকা কোথায় পাবো ? আমার ঘরে তো এক বেলা চাল কেনার পয়সাও নেই।
    -আমার যারা আছি, তাদের সবাইকে আমি বলব, তাঁরা যেন সবাই তোকে সাধ্যমত সাহায্য করে। তুই বিদেশ গিয়ে টাকা কামিয়ে তা ফেরত দিবি। তোর শ্বশুড় বাড়ি থেকে কিছু টাকা আনতে পারবি ? শুনলাম তাঁদের অবস্থা নাকি ভালোই। বোন জামাইয়ের ভালো তো তাঁরাও চান, তাই না ? তুই আজই তোর বউকে গিয়ে বল। সে যেন তার বাপের বাড়ি গিয়ে টাকার কথাটা আগেই বলে রাখে।
    মুহূর্তেই জমসেরের মনটা যেন বিদেশে চলে গেল। তাঁর ধ্যান ধারনা শুরু হল বিদেশ নিয়ে। বিদেশ থেকে টাকা কামাবো, আমাদের সংসারে আর দুঃখ থাকবেনা। সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারবো। জমসের বাড়ি যাচ্ছে। তার চোখে মুখে বিদেশে যাওয়ার নেশা জেগেছে। লতাকে বিদেশের কথা বলেও তেমন সাড়া পেলো না। জমসের অলস লোক নয়। কাজ তো করে ঠিকই কিন্তু তা দিয়ে নিয়মিত তিন বেলা খাবার জোটেনা। একদিন জমসের দুপুর বেলায় কোথা থেকে যেন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে বউয়ের কাছে ভাত চায়। লতা বলে চাল নেই। ভাত হবে কিভাবে ! জমসের চোখ মুখ লাল করে বলে, "চাল নেই তা আগে বলিস নি কেন ?"
    -গত রাতে যে বললাম, ঘরে চাল নেই। কি এক বিদেশের কথা শুনেছে, তা শুনে কাম কাজ সব ছেড়ে দিয়েছে। এভাবে কি চলবে ?

সাদাকালো -আচ্ছা তোর বাপ ভাইয়েরা টাকার কথা কি বলল ? বিদেশ কিন্তু আমি যাবোই। টাকা বিশ হাজার গুণে গুণে চাই। নইলে কিন্তু আরেক বিয়ে করব। যৌতুক বাবদ ভালোই পাবো।
    লতা কোন হ্যাঁ না কথা বলে না। চুপ করে নিজের চোখের পানি মুছে ঘরে চলে যায়। জমসের আবারও বলে, কি হল টাকা আনতে পারবি তো ? নয়তো ঘরে সতীনের জন্য অপেক্ষা করতে থাক। স্বামীর মুখ থেকে এমন কথা শুনে কোন নারীর মন উতালা না হয়ে পারে !
    হোসেনের দাদী পান চিবিয়ে লতার কাছে গিয়ে বলেন, "জমসের কি নিয়ে রাগারাগি করছে ? বিদেশের টাকা নিয়ে ? জমসের বিদেশ গেলে তো ভালোই হয়। আমাদের আর কোন অভাব থাকবেনা।" লতা বলে, "ভালো তো আমিও বুঝি কিন্তু অত টাকা আমার বাবা কোথায় পাবেন ? হাজার পাঁচেক হলে বলে আনা যেতে পারে।" জমসের গলা এগিয়ে দিয়ে বলেন, "কম হবে না। আরও বেশিও দিতে লাগতে পারে।" লতা বলে, "আমার বাপ তো টাকার গাছ বানিয়ে রেখেছেন।" জমসের লম্বা করে পা ফেলে লতার কাছে গিয়ে তার চুলে ধরে বলল, "ঠিক তাই। কই থেকে আনবি তা জানি না। সময় কিন্তু সাত দিন। আট দিনের দিন নতুন বউ ঘরে আসবে। তুই এখন যা করবি তাই হবে। নতুন বউ নয়তো টাকা।"
    লতার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। পরের দিন সকালে পড়া কাপড়েই বাপের কাছে গিয়ে সব বলে। বাপ বলে, আমি টাকা পাবো কোথায় ? লতা সারাদিন কিছূ খায় না। ভাই ভাবি চাচা চাচি মা কেউ তাঁকে খাওয়াতে পারছেন না, যে পর্যন্ত টাকা দেবার কথা রাজি না হচ্ছে। সকালে খায়নি। দুপুরেও না। রাতে বিছানায় গিয়ে আগেই শুয়ে আছে। লতার যে দুই ভাই চাকরি ও সংসার করেন তাঁরা এসে বলল, "লতা তুই খেয়ে নি। টাকা কি বাবা যোগার করে দিতে পারবেন? সেই ড়্গমতা কি বাবার আছে ? দিলে দিতে হবে আমাদেরকেই। তুই হোসেনের বাপকে গিয়ে বলিস। কাল ধান বিক্রয় করবো। ধানের দাম যদিও এখন কম। কিছুদিন পরে বিক্রয় করতে পারলে কিছু টাকা বেশি পাওয়া যেতো। তাতো আর হবে না। দুদিনের মধ্যে টাকাটা পেয়ে যাবি।" ভাইয়ের কথা শুনে লতা যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলেন। গরমের দিনেও কাথার ভিতর থেকে মুখ ও শরীর বের করে বিছানা ছেড়ে খেতে গেলেন। এমনিতেই লতার শরীর শুকনো তার মধ্যে সারাদিন না খাওয়া। পেটটা পিঠের সাথে লেগে গেছে।
    জমসেরের পাসপোর্ট করা হল। তার ফটোকপি বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হল। জমসের একা বসে হিসেব কষে, কে কত টাকা দিবে ! শামু ও জমসেরের আবাদি জমি বলতে দুই জায়গায় দুই খন্ড করে জমি আছে। এক অংশ অনেক দুরে মুফিতের জমির সাথে একই আইলে। দুই ভাইয়ে মিলে যতটুকু মুফিতের একাই ততটুকু। আর বাকি যে অংশটা বাড়ির কাছে আছে উহাও দু-ভাগে শামু ও জমসের আবাদ করেন। বৎসরে তিন ফসল আবাদ হয়।
    আজিম বলেন, "জমসের ! তোর মায়ের ঐ বাড়ির পাশের জমিটা বিক্রয় করলে হয়ে যাবে। তাছাড়া তো টাকার কোন ব্যবস্থা দেখতেছি না। তুই তোর মাকে কথাটা হালকা করে বলে দেখ, কি বলে। পরে আমি নয়তো আরও ভাইয়েরা বুর (বড় বোন) কাছে  গিয়ে বলব। তখন আর না করতে পারবে না।" জমসের বাড়িতে চলে গিয়ে চিন্তিত অবস্থায় শুয়ে আছে। লতাকে বলল, মা কোথায় ? 
    -ঘরেই তো ছিল। মনে হয় ঐ জঙ্গল পরিস্কার করছেন। একটা ঝারু ছিল তাও বুঝি শেষ করে ফেলছেন। কত বার বলি ঐ দূরের পথ পরিস্কার করার কি দরকার আছে ! বাড়ি পরিস্কার রাখলেই তো হয়। উনি বলেন, মানুষ যাওয়ার পথ পরিস্কার করলে নাকি বেহেস্তে যাওয়ার পথ পরিস্কার হবে। ঐ তো আসছেন। ঝারুটা অর্ধেক করে ফেলেছেন।
    -আচ্ছা তুমি যাও আমি মাকে বলতেছি। লতা চলে গেল। জমসের তাঁর মাকে বলল, মা, তোমার শরীর খারাপ ?
    -নারে বাজান ভালো আছে। আজিম কি তোর বিদেশের ব্যাপারে আরও কিছু বলেছে ?
    -হ তাই তো তোমার কাছে এসেছি। টাকা তো অনেক লাগবে। অথচ ভিসা কয়েক দিনের ভিতরে এসে যাবে। হোসেনের নানার বাড়ি থেকে তো বিশ হাজার এনেছি। গ্রামের মামারাও কিছু কিছু দিবেন তাতে অর্ধেক টাকাই হয় না। তুমি একটা কিছু করো মা !
    -আমি কি করবো ! বাড়ি ভিটা ও ঐ কাছের জমিটা ছাড়া তো কিছূই নেই।
    -ঐ জমিটার কথাই তো বলতে এলাম। বিক্রয় করে দিলে... !
    বিক্রয়ের কথা শুনে জমসেরের মা বলেন, "আমাকে না খাওয়ায়ে মারার ফন্দি করেছিস ?" জমসেরের কোন কথাই ওর মা শুনলেন না। জমসেরের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। জমসের রাত হলে ঘরে থাকেন না। লতা রাতে জমসেরকে কাছে পায় না। শাশুড়িকে গিয়ে বলে, "আম্মা ! হোসেনের বাপ তো ঘরে নাই। সন্ধ্যায় দেখলাম দড়ি নিয়ে যেন কোথায় গেল। এখন অনেক রাত, কোথায় পাবো ?" দোয়াতের আলো আর কতদূর যায় ! জমসেরকে খুঁজতে লতার সাথে বানু ও হোসেনের দাদীও যোগ দেন। দাদী বলেন, "বাবা জমসের কোথায় গেলি ! ঘরে আয় বাবা। হোসেন তো কাঁদছে।" জমসের গভীর রাতে কোথা থেকে যেন দড়ি নিয়ে ফিরে আসেন। লতা তখনও ঘুমায়নি। স্বামীর আশায় বসে আছেন। জমসেরের কথা শুনে ওর মা বলেন, "বাবা জমসের এসেছিস ! চিন্তা করিস না। খোদায় তোর টাকা যোগার করে দিবেন।" জমসের কোন কথা না বলে শুয়ে পড়েন। পরের দিন আজিম জমসেরকে বলেন, "এক সপ্তাহের মধ্যে ভিসা এসে পড়বে। টাকা ছাড়া কিন' ওরা ভিসা হাতে দিবে না। টাকার কিছু হল ?"
    -মাকে বলেছিলাম, কোন ভালো জবাব দেন নি। আপনি গিয়ে বললে হয়তো রাজি হতে পারেন। তাছাড়া তো কোন উপায় দেখছিনা।
    -জমিটা কিন্তু একেবারে বিক্রয় করতে হবেনা। এখন জমিটার বাজার দাম ধরে দলিল করতে হবে। পরে তুই যখন টাকা পাঠাবি তখন ঐ দাম দিলেই ওরা জমিটা আবার তোর মায়ের নামে লিখে দিবে।
    আজিম জমসেরের মাকে গিয়ে বলেও কোন লাভ হল না। বাজার থেকে জমসের একটা বিষের বোতল নিয়ে এলো। তা নিয়ে রাখলো একটা গোপন জায়গায়। রাতে হয়তো জমসের তা খাবে। রাত দশটার পরে বাড়িতে এলো। লতা বলল, তোমার কি হয়েছে ! এতো রাত জাগলে কি শরীর ভালো থাকবে ? জমসের লতার কথার জবাব না দিয়ে বলল, তুমি কি সন্তানদের মানুষ করতে পারবে ?
    তুমি পুরম্নষ হয়ে এতো কষ্ট করেই পারো না, আর আমি নারী হয়ে কেমনে পারবো? জমসেরের ধ্যান উল্টে যায়। আবার বলে, ইচ্ছে করলে মনে হয় পারবে। তাই না ? আমি এক জায়গায় যাবো। অনেক দিন ফিরবোনা। যদি ভালো লাগে আসবো, নয়তো না। লতা মুচকি হাসে। তা জমসের বুঝতে পারেন না। লতা বলে, ছেলেমেয়েদের রেখে কোথাও যেতে পারবে ? এখন ওসব রাখো, ঘূমাও রাত অনেক হল। জমসের ঘুম থেকে উঠে লুকিয়ে রাখা বিষের বোতলটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবে খাবে কিনা ! বিবেক প্রশ্ন করে, বিষ খেলেই কি সব সমাধান হবে ! হবে না। বরং বউ ও সন্তানদের কষ্টে রাখা হবে। জমসের বোতল খুঁলে মুখে দিবে অমনি লতা পেছন থেকে এসে বলে, কি খাও ? দেও আমিও খাবো। তুমি মরতে পারলে আমি পারবো না কেন ? লতা বোতলটা কেড়ে নিয়ে নিজের মুখে সবটুকু পুরে দেয়। কি হবে লতার ! হয়তো মিনিট কয়েক পড়ে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
    -তুমি একি করলে বউ ?
    -কেন খারাপ কিছু তো করি নি। যা তুমি করতে আমাকে একা করার জন্য, তা আমি করেছিলাম তোমাকে একা করতে।
    লতার চোখ বুজে যাচ্ছে। জমসের চিৎকার করতে লাগলেন। বাড়িতে লোক জড়ো হল। হোসেনের দাদীও কাঁদতে থাকেন। বলেন, এই জমিটার জন্য বউমা তুমি বিষ খেলে ! তুমি ভালো হও কালই আমি জমসেরের টাকার জন্য জমিন লিখে দিবো। লতাকে উঠোনে শুয়ে দিয়ে জমসের তাঁর মুখে অবিরাম পানি দিয়ে বমি করানো চেষ্টা করছেন। সবার মুখে একই কথা, লতা কেন বিষ খেলো ? লতার দেহ নিস্তেদ হয়ে গেছে। শরীরে কোন বল নেই। বিষ খেলে তো গন্ধ করার কথা ছিল, কিন্তু তেমন কোন গন্ধ নেই। এর ভাবনা উপস্থিত দু-একজন করলেও বেশীর ভাগই ভাবছেন না। একটু পড়ে লতা চোখ খূঁললো সবাই যেন চিন্তামুক্ত হল। ধীরে ধীরে মানুষ কমতে থাকে। লতা উঠে নিজ হাতে কাপড়ের ময়লা ধুয়ে ঘরে যায়।
    রাত প্রায় শেষ হওয়ার পথে। লতা হঠাৎ করেই হাসতে থাকে। হোসেন শুনেছে কেউ পাগল হলে নাকি তার প্রথমে তিনি হাসতে থাকেন। মাকে বলল, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ? লতা বড় বড় চোখ বের করে বলল, বাবা তুমি গিয়ে ঘুমাও কাল সকালে কথা বলবো। হোসেন চলে গেল। জমসের বলল, আমাকে তো ভয়ে ফেলে দিয়েছিলে। কোন দিন স্বপ্নেয় ভাবিনি তুমি বিষ খাবে। লতা আবার হাসতে থাকে, বলল, পানি খেলে কেউ কি মরে ? আমি তো পানি খেয়েছিলাম। তুমি যখন বিষের বোতলটা এনে লুকিয়ে রাখলে আমি তা দেখেছিলাম। জানি তুমি টাকা যোগার করতে পারোনি বলে বিষ খেয়ে মরতে চাও। কিন' একবার ভেবেছিলে আমাদের কি গতি হবে ? রাতে হয়তো তুমি তা খেতে। তাই আমি তা গোপনে সরিয়ে ফেলে দিয়ে ভালো করে গরম পানি দিয়ে বোতলের ভিতরের অংশ ধুয়ে তার মধ্যে পানি ভরে সেখানেই রেখেছিলাম। পাশের ঘর থেকে হোসেনের দাদী জমসেরকে বলেন, "হোসেনের মায়ের অবস্থা কি আগের চেয়ে ভালো ?"
    হ মা। তুমি ঘুমাও আমি ওর কাছেই আছি। জমসের লতার পানে চেয়ে বলল, তুমি সত্যি বুদ্ধিমান একজন বউ। মা কিন্তু কালই জমি দলিল করে দিবেন। এক কাজে বাধা দিতে গিয়ে দুই কাজ সফল হয়ে গেল।
    ভিসা এসেছে। জমসেরের টাকাও জোগায় হয়ে গেছে। এখন কাজ মানুষের কাছ থেকে দোয়া নেওয়ার। জমসের শ্বশুড় বাড়ি গেল। তাঁর দাদী শাশুড়ির পিঠ কুঁজো। ধনুকের মত বাঁকা হয়ে ঘর থেকে বের হয়। জুরম্নরি কাজ সেরে আবার ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকেন। তবে তিনি চিত হয়ে শুতে পারেন না। সারাদিন দোয়া কালাম পড়েই সময় পার করেন। সবার কাছে বলে শেষে তিনির কাছে গিয়ে দোয়া নিয়ে জমসের বাড়িতে চলে যাান।
    বিদেশ যাওয়া সব ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ। বিমানের টিকেট কাটা হয়ে গেছে। জমসেরের সাথে লতা ঢাকা পর্যনত্ম যেতে চেয়েছিল, তা আর হয়নি। সাথে আজিম ও হোসেনের মামা যান। যখন জমসের বাড়ির আঙ্গিনা ছেড়ে যাবে তখন হঠাৎ করেই শাশুড়ি মানে হোসেনের নানী জমসেরের হাত ধরে কাঁদতে থাকেন। সেই কাঁদন সবাইতে আবেগময় করে তোলে। উপস্থিত কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি। লতা তো সেই যে ঘরে বসে আছেন, তাঁর মুখে কোন কথা নেই। তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে সে কিভাবে এখন দিন কাটাবে ! জমসের চোখ পানিতে টলমল করছে। হাতে তার ব্যাগ, তার মধ্যে পাসর্পোট বই ও বিমানের টিকেট সাথে অন্যান্য কাগজপত্র। মালামালের ব্যাগটা মালে ভরে গেছে। তা অবশ্য জমসেরের সব না, বিদেশে যাঁরা থাকেন তাঁদের বাড়ির লোকেরা তাঁদের জন্য কিছু পিঠা ও দেশীয় ফল দিয়েছেন।
    জমসেরের চোখে মুখে অনেক স্বপ্ন অনেক আশা। তিন ছেলে মেয়েকে বুকে নিয়ে জমসের কেঁদে ফেললো। শেষে একটা কথা লতাকে বলল, সন্তানদেরকে তোমার আঁচলে আগলে রেখো। তাদেরকে ভালোভাবে মানুষের মত মানুষ করো। শামুর সাথে জমসেরের তেমন কথা হয় না। জমসের বলতে চাইলেও শামু বলেন না। আজ কোন হিংসে নয়, তাই জমসের নিজে তাঁর ঘরের কাছে গিয়ে বড় ভাই শামুর হাতে ধরে বললেন, "ভাই ! আমার সন্তান মানেই তোমার সন্তান। তাদেরকে প্রয়োজন হলে ধমক দিও, তবুও তাদের দিকে একটু খেয়াল রেখো।। লতা মেয়ে মানুষ সে সব বুঝবেনা।" আজিম এগিয়ে গিয়ে বললেন, "তুই বিদেশ গিয়েই আগে ধার কর্জের টাকাটা আগে শুধাবার চেষ্টা করবি। তারপর কালুকে বিদেশ নেওয়া ভাবনা। সব ঠিক তো ?" জমসের মাথা নাড়ে, জি।
    জমসের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে রাতে ঘুমাতো। সন্তানদেরকে মশায় কামড়ালে গামছা দিয়ে নিজ হাতে রাতভর মশা তাড়াতো। মেয়ের জন্ম তখনও হয়নি। মশাগুলো তাঁর কিংবা সন্তানদেনদের শরীরের রক্ত খেয়ে পাশেই মাটির দেয়ালের সাথে বসে থাকতো। অনেক মশার পেট রক্তে ভরা থাকতো। জমসের হায় হায় করে বলতো, শালার শুয়র মশা, আমার বাজানদের রক্ত খেয়েছিস ! তোদের রক্ষা নেই। বিড়ির আগুন একটা একটা করে মশার পাছায় ধরতেন। এই ভাবে রাত প্রায় দুটো তিনটা বেজে যেতো মশা মারতে। সেই মশারি ছাড়া মশা মারার দিনগুলোর কথা জমসের কি বিদেশ গিয়ে ভুলতে পারবেন ?
    সারাদিন শেষে পরের কাজ করে সোয়া সের চাল ও ক’টা টাকা পেতেন। সোয়া সের চাল দিয়ে তো চার জন মানুষের সারাদিন চলে না। তার মধ্যে সবজী ও মসলা কিনতে হয়। এমনও দিন গেছে হোসেনের দাদী সারাদিন কাপড়ের অভাবে গোছল করেন নি। তখন অবশ্য লতার বিয়ে হয়নি। জমসেরের দু-বোনেরও তখন বিয়ে হয়নি। সেই দিনও চলে গেছে। জমসেরের জন্মই যেন কষ্ট করার জন্য। তবুও মনে এখন আশা, যে করেই হোক ছেলেমেয়েদেরকে লেখাপড়া করাবেই। তাদেরকে পরের কাজ করার জন্য পাঠাবে না।     জমসের ও লতা উভয়েই ধর্ম ভীরু লোক, নিয়মিত নামাজ পড়েন। হোসেনের দাদীও নামাজ পড়েন তবে তার নিয়ম একেক সময় একক রকম হয়। যেমন- শীতের সময় নফল নামাজগুলো পড়েন না। আর অন্যান্য নামাজের ক্ষেত্রেও সময়ের দীর্ঘতা অনেক কমিয়ে দেন। ত্রিশ কি:মি: বেগে নামাজ শেষ করেন। নামাজ শেষে চুলার ধারে গিয়ে বসেন। শীতের সময় তো তাঁর চুলার ধারেই দিন যায়। কালি লেগে কাপড় ময়লা হয়ে যায়, জ্বালানির গন্ধে তাঁর কাপড়ের কাছে যাওয়া যায় না।
                                                                                                                                                         চলবে

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

[blogger]

sislam8405

{Facebook#https://www.facebook.com}

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget