সাদাকালো ।। Shadakalo ।। বাংলা উপন্যাস ।। Bangla Novel ।। প্রথম পার্ট



(প্রথম পর্ব)
গ্রামের নাম পূবহাটি। হোসেনদের বাড়িতে গ্রামের সব প্রথম শ্রেণীর মাতাব্বররা এসেছেন। অন্য গ্রাম থেকেও কয়েকজন এসেছেন।। তাঁদের মধ্যে কামরুল ও কসিম অন্যতম। কামরুল পাচুয়া গ্রামের অশিক্ষিত চতুর ও তুখোড় মাতাব্বর। সে একাধারে দশ বৎসর যাবৎ নিজের গ্রামসহ ও আশেপাশের গ্রামে মাতাব্বরি করে আসছে। বাড়িতে তার কোন ছাল বাক্স কিছুই নাই।
    নিজের ঘরটাও এক মহিলা গড়ে  দিয়েছে। মহিলার স্বামী বিদেশে থাকে। স্বামী মাসে মাসে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠায়। মহিলার দুই মেয়ে বড় হয়ে আছে। কোন বিয়ে কথা আসছে না। মেয়ের বাপ বিদেশ থেকে বার বার বলছে, "যত টাকা লাগে ওদেরকে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিও। আমি কিন্তু ওদের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত দেশে আসছি না।"
    মহিলার নাম কপিলা। কামরম্নলের চেয়ে অনেক বড়। কপিলা নাম অবশ্য আগে ছিল না, ছিল কমলা। বিয়ের পর স্বামীই এই নামটা রেখেছিল। কমলাও অমত করেনি। সেই থেকে কপিলা নামেই আছে। কপিলার স্বভাব ভালো না। সারাদিন এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। স্বামী বিদেশ থেকে ভিসা পাঠায়। সেই  ভিসার প্রার্থীর জন্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে কপিলা লোক খুঁজে বের করে। কোন সময় সহজেই পাওয়া যায়, আবার অনেক সময় ভালো শরীর গঠনের লোক পাওয়া যায় না। বুড়ো লোকদের অনেক মালিকই পছন্দ করেন না। গাল ভাঙা, মাথার চুল পাকা অমন লোক দিয়ে কাজের কাজ কিছুই হয় না। কপিলা ভিসা বিক্রয়ের সব টাকা নিজের হাতে পায়। স্বামীকে বলে, "আরও ভিসা পাঠাও, এবার দুই তরম্নণ যুবক পাওয়া গেছে। গরীব কিন্তু, সহজ সরল, এখনও বিয়ে করেনি।" স্বামী ফোনে বিবরণসহ বলে;
    -দুটো ভিসা দিলে কি ওরা দুজন আমার মেয়েদের বিয়ে করবে ?
    -এখনও বলিনি তবে বললে রাজি হতে পারে। কিন্তু টাকা তো হাতে পাবো না।
    -টাকাই কি সব ! মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে না ?
    -আর কিছু দিন যাক না। এখনও তো ওদের শরীরের সব কলকবজা ঠিকঠাক হয়নি।
    -আমিও তো তোমাকে অমন বয়সেই বিয়ে করেছিলাম, কই কোন সমস্যা তো হয়নি। মেয়ে যেহেতু তাই বিয়ে দিলেই চিন্তাটা কমে যায়। যত দ্রত পারো ব্যবস'া করো।

    রাত দিন নেই কপিলা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। ওর কাছে অবশ্য ছোট একটা চাকু থাকে। আমের সিজনের সময় পথ দিয়ে হাঁটার সময় ঢাল থেকে আম পেড়ে চাকু দিয়ে কেটে খায়। কপিলা আর কি জন্য যে নিজের কাছে চাকুটা রাখে কেউ জানে না। কি দরকার আছে রাতের বেলায় পথ দিয়ে একা একা হাঁটার ? আর কি দরকার আছে নিজের কোমরে চাকু লুকিয়ে রাখার?
    কপিলা বয়স কালে একটা সুন্দরি মেয়ে ছিলেন। এখন অবশ্য গায়ের চামরা কালো হয়ে গেছে, গালটাও ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। দেহের জোশ কমে যাচ্ছে। কিন্তু কপিলা তো নিজেকে বুড়ো হতে চায় না। কি খেলে আরও অনেক দিন জোয়ান থাকা যায়। সেই জন্য কবিরাজের বাড়িতে যায়। ডাক্তারের কাছে গিয়ে টাকা ঢালেনা। লাভের লাভ কিছুই হয় না ডাক্তারের কাছে গেলে?
    কপিলার মুখে রুচির কোর অভাব নেই। সামনে ভাতের থালা পেলে মুখ আর চুপ থাকে না। তা হোক না শুধু লবন মরিচ দিয়ে ভাত। আটাশের কোমর এখন চুয়াল্লিশ হয়েছে। বুকের মাপ দ্বিগুণ হয়েছে। কিছূ দিন আগেও যারা তুই তুমি বলে ডাকতো তারা এখন আপনি বলে ডাকে। কপিলা ঘরে রাখা আয়নায় নিজের মুখ দেখে নেয়। মেয়েদের কাছে জানতে চায়, "আমি কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি ?" মেয়েরা বলে, "আমরাই তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছি আর আমাদের মা হয়ে তুমি হবে না !" কপিলা সত্যি যেন চিন্তায় পড়ে যায়। টিবিতে বিজ্ঞাপন দেখে বাজার থেকে বিভিন্ন কসমেটিক কিনে গালে ও শরীরে মাখতে থাকে। কাজের কাজ কিছুই হয় না। আরও বেশী ব্যবহারের কারণে চামরায় কালো দাগ বেড়ে যায়।
    কামরুলের সাথে কপিলার দিনে পাঁচবার দেখা হবেই। কপিলা যাবে কামরুলের বাড়ি নয়তো কামরুল যাবে কপিলার বাড়িতে। কামরুলের মাকে রেখে ওর বাবা অনেক আগেই আরেক বিয়ে করেছেন। আর ওদের ভরণ পোষনের দায়িত্ব নেননি। সেই মা কামরুলকে খেয়ে না খেয়ে এতোটুকু বড় করেছেন। বড় করেছেন ঠিকই কিন্তু কাজের বড় করতে পারেন নি। হয়েছে আচ্ছা একটা বাটপার ধান্দাবাজ লম্পট। সে আছে মেয়েলি কারবারে। কামরুলের মা তিন বৎসর আগে মারা যান। কামরুলই মেরেছে। কামরুলের কাজে যে বাধা দিবে তার কোন রক্ষা নেই। সে হোক না রক্তের কেউ। কামরুল মদের বোতল বাড়িতে নিয়ে যেতো। ঘরে বসেই খেতো। কখনও মেয়েদের নিয়ে মায়ের সামনেই ফুর্তি করতো। মা মানা করলেও সে শুনতো না। একদিন কামরুল রাতের বেলায় মায়ের চকিতে বসে মদ খাচ্ছে। ওর মা তখন পাশেই ঈশার নামাজ পড়তে ছিলেন। মদের গন্ধে নামাজের সমস্যা হচ্ছিলো। শুধু ফরজ নামাজ আদায় করে বলেন, "খেতে চাস তো একটু বাহিরে গিয়ে খা না ! দেখছিস না আমি নামাজ পড়ছি ?" কামরুল কিনা কি বুঝে মদের বোতল দিয়েই মায়ের মাথায় আঘাত করে। ক্ষুদ্র্র একটু চিৎকার করে তিনি পরপারে চলে যান। সেদিন মায়ের জন্য সামান্য কান্নাও কামরুল করেনি।
    পরের দিন গ্রামের লোকজন তাঁর মায়ের কাফন ও দাফনের ব্যবস্থা করেন। লোকমুখে কথা উঠেছিল যেহেতু অনাকাঙ্খিত মৃত্যূ তাই পুলিশকে খবর দেওয়া উচিত ! কেমন করে যেন এ কথা কামরুলের কানে যায়। কে বলল তা জানতে উঠে পড়ে লাগলো কামরুল ! কে অভিযোগ করবে কিংবা বাদি হবে ? তার মাথা কী কামরুল জিন্দা রাখবে ? গ্রামে সালিস বসলেও তার বিচারক তো কামরুলই। আর যাঁরা বিচারক হিসেবে থাকবেন তাঁরা তো কুকুরের মত লেজ নিজের পাছা দিয়ে ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন কিংবা চেয়ার থাকলেও মাটিতে বসবেন।
     কিছূ দিন আগে মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে কপিলা এক বাড়িতে ছেলের খুঁজে যায়। তা পূবহাটি থেকে সামান্য দূরে দমতল গ্রাম। আগে যারা এসেছিল তারা সবাই চলে যায় রাতে বিরাতে এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে বেড়ায় মেয়ের মা তা শুনে। কপিলা যায় কামরুলকে সাথে করে নিয়ে। ছেলে বাপ বলেন, "উনি কে, আপনার স্বামী ? তা কবে বিদেশ থেকে এলেন ? আমরা তো ভেবেছি আসতে আরও দেরি হবে।"   এমন কথা শুনে কপিলা কামরুলের দিকে তাঁকায়। নিজেদের মাঝে চোখের মাধ্যমে গোপনে কথা হয়। খানিক পরে কপিলা বলে, "জি কিছুদিন হল এসেছে। তা আপনাদের খবর জানতে এলাম, কবে মেয়ে দেখতে যাবেন ?" উঠোনে বসা কামরুল ও কপিলার চারপাশে বাড়ির সব ছেলে মেয়ে ও মুব্বুবিরা দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা একটু বাড়ির বাহিরে কাজে গেছে। ছেলের বাপ কথা বললেন, "আমরা নগদ টাকা ও সোনা চাই। সোনা না দিলেও মেয়েকে ভালোভাবে সাঁজিয়ে দিতে হবে। কিন্তু টাকাটা আগেই চাই।"  কপিলা কামরুলের দিকে তাঁকিয়ে বলে, "রাজি হবো ?"  কামরুল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। মোটামুটি কথা দুপক্ষের মাঝে হয়ে যায়।
    কপিলা ও কামরুল বাড়ি ফিরে যায়। কপিলা বলল, "এক কাজ করলে কেমন হয় ! বিয়ে তো দিব এক মেয়েকে, আরেকটা তো থাকবেই। ওটা ইচ্ছে করেই পরে বিয়ে দিবো। আমার স্বামী বলেছে যতদিন দু-মেয়ের বিয়ে সম্পূর্ণ না হবে ততদিন দেশে আসবোনা। এই সুযোগে তোমার আমার বিয়ে হলে কিন্তু মন্দ হয় না।’    
    -তোমার মত বয়স্ককে আমি বিয়ে করবো ! তাছাড়া তোমার মেয়েই প্রায় আমার সমান হয়ে গেছে। এসব চিন্তা বাদ দিয়ে অন্য পথ ধরো, বুঝলে ?
    -যদি টাকা দেই তবুও না ? তোমার তো ঘর নাই, একটা ঘর দিয়ে দিলে ?
    -ঠিক আছে। তবে কেউ যেন জানতে না পারে। যদি জানে তবে তো আমার মুখে সবাই থূঁ থুঁ দিবে। বলবে, ঐ বয়স্ক মহিলা ছাড়া কি জগতে মহিলা ছিল না। ঐ দুই মেয়ের মায়ের মাঝে কি পেলি ?

    কামরুলের ঘরের কাজ চলছে। সবাই ভাবছে আর বলছে, কিরে কামরুল এতো টাকা কোথায় পেলি ? নাকি আবার কারো ঘরের মাল চুরি করেছিস ? কামরুল বলে, ’হয়তো তাই হবে। চুরি ছাড়া কি এতো টাকা পয়সা আমার হয় ? চুরি ডাকাতি যাই করি না কেন তা কোন বাড়িতে না, করেছি রক্ত মাংস থেকে।’ কামরুলের কথা জনগণ কিছুই বুঝেনা। ঘরের কাজ মোটামুটি যখন শেষ তখন ওদিকে ছেলের বাপ খবর দিয়েছেন ছেলেকে তাঁরা এখনই বিয়ে করাবেন না। এখন বিদেশ পাঠাবে, তারপর ভাবা যাবে। এমন খবর শুনে কামরুলের তেমন প্রতিক্রিয়া না হলেও কপিলা শুনে মাথায় হাত দিল। যে বুদ্ধি করে যাকে ঘর বানিয়ে দিলাম, অথচ কাজের কাজ কিছুই হবে না। হায় হায় রে তরতাজা টাকাগুলো কামরুলের ঘরের জন্য খরচ করলাম। ওকি ঘর বিক্রয় করে এখন টাকা ফেরত দিবে ? ও যে বাটপার মনে হয় না দিবে, তার চেয়ে ওকে আগে থেকেই হাত করে রাখলাম। কিন্তু ওর আর আমার বিয়েটা তাহলে এখন সেরে কি লাভ ! থাক। মাথায় যে মাঝে মাঝে কি ঢুকে মগজটারে অগোছালো করে দেয় !

    কামরুল ও কসিম পাশাপাশি দু চেয়ায়ে বসে আছেন। কসিমের ঘরেই এক বেলার খাবার থাকলে পরের বেলায় থাকেনা। বাড়ির উঠোনে কোন দিন নিজের জমিনের ধান উঠেনি। ধানের খড় কিংবা বিছালি কাকে বলে তা জানেন না। ঘাস বাড়ির উঠোন ছেয়ে ঘরের মেঝের দিকে যাচ্ছে। বউ মাঝে মাঝে কোদাল দিয়ে চেঁচে কিছুটা তোলেন। ওদের বাড়িতে কোন স্বাভাবিক লোকদের আনাগোনা নেই। ওদের বাড়িতে যাঁরা যান। তাঁরা সবাই ঘুসখোড় কিংবা ঘুস দেওয়ার লোক। ঘুসখোড়দের মুখের চিবুক অনেক শক্ত, উহাই ওদের বেঁচে থাকার সম্ভল। যদি কোন দিন কোন গাছের ঢালে কিংবা বাইকের ধাক্কায় চিবুক মচকে যায়। তবে ওদের পরিবারের কি গতি হবে ! কে তাদের মুখে খাবার তোলে দিবে ! তখন তো কর্তা চাপাবাজি করে মাল কামাতে পারবেন না।
    অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর কসিম বললেন, "আজকে কি জন্য আমাদের ডাকা হয়েছে তাই তো জানা হলো না।" কসিম হোসেনের এক দুঃসম্পর্কের ফুপা হন। হোসেনকে কসিম বললেন, "কি হয়েছে ?" হোসেন বলল, "আমিই তো জানি না কি জন্য আপনারা এ বাড়িতে এসেছেন?" কামরুলের হাতে পাইপ। দু-দুবার আগুন ধরাতে গিয়েও উহাতে ধরাতে পারেনি। অবশেষে হোসেনদের রান্না ঘরে গিয়ে পাইপে আগুন ধরায়। লতা তখন দুপুরের রান্না শেষ করে ঐ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। লতা হোসেনের মা। কামরুল বলল, "কিরে ভাবি, কি রান্না করছিস ? সকালের খাবারটা ভালো হয়নি। কিছু হবে নাকি ?" লতা উঠোনের দিক থেকে মুখ সরিয়ে রান্না ঘরে বসা কামরুলের দিতে তাকিয়ে বলল, "একটু পরে খেয়ে যেয়ো। এখন দেখো না আবার কিসের বেজাল লেগেছে। সারাটা জীবন আমার শাশুড়িরটা খেয়েছেন এখন আবার স্বামীর হার খাটুনির টাকা খেতে এসেছেন। ওদের বিচার খোদায় করবেন। এই ভর দুপুরে হাত তোলে বলছি। খোদায় অবশ্যই শুনবেন।"
    আজিম জোবের ইয়ামিন মুফিত ও মুকিতসহ আরও অনেকেই এসেছেন। ওরা সবাই হোসেনের দাদা হন। অর্থাৎ হোসেনের দাদীর চাচাতো ভাই। আজিমও কামরুলের মত নিজের গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামের মাতাব্বর। তাঁকে অনেকেই ভয় পান। যেমন লম্বা সুন্দর তেমন দেহের গঠন। কারো দিকে চোখ তোলে কথা বললে তাঁর পা কাঁপা শুরু হয়ে যায়। আজিম লতাকে বললেন, "এই বেটি তোর অমন পেনর পেনর কথা আমি শুনতে আসিনি। আসল কথা বল। জমসেরকে বল দু-মাসের ভিতরে কালুকে বিদেশ নিতে হবে। নয় কিন্তু তোর এই ঘরের টিন খুঁলে আমার বাথরুমের বেড়া বানাবো।" লতা আজিমকে কিছু ভয় আগে পেলেও এখন পান না। কারণ একই কথা বারেবার  শুনতে বিরক্ত । লতা বলল, "আর দেরি কেন, খুঁলে নিয়ে যান। জীবনভর তো আমার শাশুড়িরটা  খেয়েছেন এখন আর তো কিছু নেওয়ার নেই, ঘরের টিন খুঁলে নিয়ে যান। আমি কিছুই বলবো না, ঐ খোদায় বিচার করবেন।" আজিম বসা থেকে উঠে বললেন, "এই বেটি কথা কম বল, নইলে কিন' গলা থেকে শ্বাস নালি টেনে বের করব।"  লতা বলল, "করেন দেখি, কত ক্ষমতা আপনার ? আমার  ভাইরেরা কম প্রভাবশালি না। একবার আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখেন না। আপনার মত লোক কোন দূয়ারে নিয়ে যাই।"
    কসিম মনে মনে ভাবলেন, "এখানে বসে থাকলে চলবে না। কিছু করতে হবে। আজ কোন বাড়তি  কামাইয়ের আশা করা বৃথাই।" লতাকে বলল, ’দেখেন ভাবি আপনারা তো একই বংশের দুটো মাত্র পরিবার। কেন এই দায় অন্যেও ওপর দেন। একজন না খেয়ে থাকলে কি আপনার মনটা ভালো থাকবে ? কালু আপনার ভাতিজা। ভাইকে বলে দেখেন না, যদি তারাতাড়ি বিদেশ নিতে পারেন। তাহলে তো আর আজকের মত এখানে সবাইকে মিলিত হওয়ার দরকার পড়ে না।"   লতা বলল, "দেখো কসিম, আমি বারবার হোসেনের বাপকে বলতেছি, যত কষ্টই হোক তুমি কালুকে বিদেশ  নেও। নইলে কিন্তু এ বাড়িতে আমার থাকা নিরাপদ নয়। আজ না হয় তুমি এসেছো কিন্তু এই মামারা সপ্তাহে সাতদিনই আসেন। আর কত সহ্য হয় ! বলতেছি তো হোসেনের বাপে চেষ্টা করতেছেন।"

    জোবের লোকটা কিছু ভিন্ন ধরনের। তিনি নিয়মিত মদ খান। রাত যখন গভীর হয় তখন মদের জন্য উত্তসর গ্রামের হরেরামের কাছে যান। হরেরাম অবশ্য মদ বানায় না। মদ বানায় তার বউ অবোলা ও মা মৌতাশি। ছেলে কৃষ্ণ ইদানিং আধুনিক মদ মানে ডাল বানায়। যাঁরা খান তাঁদের কাছে এই হরেরামের ডালের অনেক চাহিদা। আগেই অর্ডার না দিলে পাওয়া যায় না।
    নান্টু ও শামিম তো হরেরামের ডালের নিয়মিত অগ্রিম ক্রেতা। ওরাও ওই উত্তসর গ্রামের বাসিন্দা। প্রতি রাতে দু-বোতল না হলে ওদের চলেই না। রাত দশটা বাজলেই ওরা দুজন হরেরামের ঘরের দরজায় গিয়ে হাঁক ছাড়ে। হরেরাম অবশ্য এতো তারাতাড়ি ঘূমায় না। ওদের কাজটাই তো রাতে হয়।
    হরেরামরা সবাই কালো। দাঁতগুলো দেখে মুখ চিনতে হয়। অবোলা বিয়ের আগে চিকন ছিল। বাপের বাড়িতে ডালের কথা আগে শুনেনি। স্বামীর বাড়ি এসেই জেনেছে। এখন তো ডাল বানাতে অবোলাই মূল একজন। মৌতাশিও বানাতে পারেন তবে জনগণ বিভিন্ন মন্তব্য করে। তাই ইদানিং মৌতাশি তেমন বানান না। তাছাড়া শরীরের তেমন জোর নেই। অবোলা কালো ও চিকন থাকলেও এখন শরীরে মাংস বেড়ে দেহের গঠন ভালো হয়েছে। জোবের ওর কাছে গিয়ে বসে ডাল খান। জোবের ঢোলে অবোলাও ঢোলে। কখনও জোবের অবোলার ওপর হেলে পড়েন। ডাল খাওয়ার সময় নাকি যুবতি মেয়েদের কাছে রাখতে হয়। তাছাড়া মজমা জমে না। কিন্তু যুবতি মেয়ে তো পাওয়া সম্ভব না। অবোলাকেই জোবের, নান্টু ও শামিম আরও যাঁরা যান তাঁরা সবাই যুবতি ভেবে নেন। কালো হাতের ওপর সুন্দর কিংবা কালো হাত পড়ে। হরেরাম তখন কাছে থাকেন না। কাছে থাকলে ডালের দাম কম পাবে আর যদি বউকে দিয়ে একটু সুযোগ দেয় তবে দাম বেশী পাবে। হরেবাম ভাবে, "কি ক্ষতি হবে একটা হাতটা ধরলে ? ধরুক না। মাত্র তো পাঁচ দশ মিনিটের ব্যাপার !" 
    জোবেরের বাপের সম্পদ তো কম ছিল না। তিনি ভাগে যা পেয়েছিলেন এখন তার কিছুই নেই। থাকার মধ্যে বউ ও দুই ছেলে এক মেয়ে আছে। সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। ইহা অবশ্য তাঁর জন্য অনেক গর্বের বিষয়। কি হবে টাকা করি ধন সম্পদ দিয়ে ? যদি সন্তানরা শিক্ষিত না হলো ? মেয়েটা দ্বিতীয়। কালচে ও সুন্দরের মাঝামাঝি তার রম্নপের বর্ণনা চলে।
    জোবেরর ছোট ভাই আজিম। ওদের এক ছোট বোন ছিল। বোনটা নাকি কালো ছিল। বাপ যখন তাঁর বিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক টাকা খরচ করতে মনসি'র করলেন। তখন আজিম বাধা দিল। বলল, "কি দরকার আছে এতো টাকা যৌতুক দিয়ে আমাদের বোনের বিয়ে দেওয়ার ?’ বাপে বললেন, ’কি বলতে চাস ?"  
    -ওর জন্য ওতো টাকা যৌতুক দিতে দিব না। টাকা ছাড়া যদি কেউ নেয় নিবে, নয়তো এ বাড়ির কাজে মেয়ে হিসেবে রেখে দিব। কাজের মেয়ে তো আমাদের লাগেই।
    -নিজের রক্তের বোনকে বিয়ে না দিয়ে বাড়ির কাজের মেয়ে হিসেবে রাখবি ? এমন কথা আর বলিস না। কথা ফেরত নি, নয় কিন্তু ধ্বংস হয়ে যাবি। ভবিৎষতে তোর ছেলে মেয়ে দিয়ে তোর সুখ হবে না।
    -সোজা কথা দিতে পারবানা। মনে থাকে যেন।

    বাপের নাম পঙ্কজ। বাপ জোয়ান থাকতেই ছেলে এমন কথা বলে, বুড়ো হলে তো বাপের খবর নিবেই না ! পঙ্কজের নাম ডাক কম না ! যেমন রাগ তেমন তাঁর রাগের ব্যবহার। একবার বিয়ের পর মধ্য বয়সকালে দমতল গ্রামে কি এক প্রয়োজনে যেতেই সামনে এক খেয়া ঘাট পড়লো। ঘাটে মাঝি নেই। মাঝির বাড়ি আবার ঘাটের পাশেই ছিল। পঙ্কজ জোরে হাঁক দিয়ে বলল, " এ মাঝি বাড়িতে আছো নাকি ? আমার ওপারে যাওয়ার খুব তাড়া আছে। যদি আমায় দয়া করে পার করে দিতে।"
    মাঝি হুক্কা টানছিল। তার বউ মাঝির শরীরে তেল মাখছিল। কিছূক্ষণ আগে জলে নেমে মাছ ধরেছে। জোকে ধরেছিল, দুটো কামড় দিয়ে রক্ত খেয়েছে। তাছাড়া জলে অনেক ধরনের পোঁকা থাকে তার মধ্যে এক ধরনের পরিচিত পোঁকা থাকে যা শরীরে কামড়ায়। কিন্তু তেল হালকা গরম করে মাখলে চুলকায় না, কিংবা আরাম লাগে। মাঝি বউকে বলল, " দেখো তো কোন বদমাস আমায় অমন ভাবে ডাকছে, আমার কি সম্মান নেই?" মাঝির নাম মদন। বউ এগিয়ে গিয়ে বললেন, "একটু বসেন। মাঝি এখন তেলের আরাম নিচ্ছে। নেওয়া হলেই নাও ছাড়বেন।"  পঙ্কজের রাগ বাড়তেছে, মনে মনে বললেন, "কি বলে শালার মাঝি ! আমাকে বসিয়ে রেখে তেল মাখে গায়ে ! এই পঙ্কজকে শালা তুই চিনিসি নি। চেনাবো আগামী বৎসর।"
    কি করবে পঙ্কজ এই মদন মাঝির ? তা আর পঙ্কজ প্রকাশ করল না। সহ্য করে বসে রইল। এর একটা বিহিত করতেই হবে। পঙ্কজ নায়ে বসে মদনকে বলল, "এই ঘাটে তুমি কত সময় ধরে নাও বাইছো ? অন্য কেউ এই ঘাট ডাকে না ?"
    -দশ বৎসর হল। আমাকে ছাড়া ডাকার কেউ নেই।
    -আগামী বৎসর যদি কেউ বেশী দাম দিয়ে ডেকে নিয়ে যায়, তবে তোমার কি হবে ?
    -আমি নিশ্চিত কেউ ডাকবে না।
     পঙ্কজ নাও থেকে নেমে পয়সা দিয়ে চলে গেলেন। দু-দুবার পঙ্কজ মদনের দিকে পেছন ফিরে তাঁকিয়ে রইলেন। শালার বেটা আগামীতে দেখবি আমি কি জিনিস ! বছর ঘুরে পরের বৎসরও নিদিষ্ট সময়ে ঘাটের ডাক হল। কেউ আর দ্বিতীয় ডাক দেয় না। মাঝি সেই যে ছোট একটা ডাক দিয়ে রেখেছে তাই চলছে। হঠাৎ করে পঙ্কজ বললেন, "আমি তার পাঁচগুণ বেশী দেবো।"  সবাই পঙ্কজের দিকে তাঁকিয়ে রইলেন, বলল, "আপনি কে, কোথায় বাড়ি ?" পঙ্কজ ভালো দামি পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পড়ে সামনে গিয়ে নগদ টাকা দিয়ে ঘাট কিনে নিলেন। মদন হা করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনের মাঝে তার সেই এক বৎসর আগের কথা খেয়াল হল। এতো সেই লোক। কিন্তু উনি ঘাট কিনে কি করবেন ? মদন কোমরের গামছাটা গলায় ঝুলিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। ভাবলো, ঘাট কিনলেই হবে না। তা চালানোর লোক থাকতে হবে। ক’দিন পরে আমার ঘাট আবার আমার কাছেই ফেরত দিয়ে দিবে।
    ঘন্টা দুই না যেতেই পারাপার লোকেরা বলাবলি করা শুরু করল। কি ব্যাপার যে লোকটা ঘাট কিনলো, তিনির মাঝি ও নাও কই? আমাদের তো সব সময় পারাপার হতে হয়। পঙ্কজের বাড়ির ঠিকানা জেনে ক’জন তাঁর বাড়িতে গেলেন। তিনি বাড়িতেই ছিলেন। বাড়ি দেখে তো লোকজনদের কপাল কুঁচকে গেল। একজন বলল, "আপনি ধনী মানুষ কি ভেবে ঘাট কিনলেন ?" পঙ্কজ বললেন, "আমি তো ঘাট কিনেছি শখ করে। কিনলেই যে তা চালাতে হবে না তো কথা হয়নি। আমি টাকা দিয়ে কিনেছি, আমার ইচ্ছা আমি নাও চালাবো না।"  লোকজন হাত জোড় করে বলল, "দেখুন, জানি না কার ওপর রাগ করে এমন করছেন। তবে এতে লোকদের সমস্যা হচ্ছে। তাই বলি মানুষের কষ্টের কথা ভেবে ঘাটটা বিক্রয় করে দেন, নয়তো পারাপার করার ব্যবস্থা করেন।" পঙ্কজ তার রাগের কারণ বললেন। পরের দিন মদন ও তার বউ আরও গ্রামের ক’জন লোক এসে টাকা ফেরত দিয়ে ঘাট কিনে নিয়ে যায়। শখের তোলা আশি টাকা। জিদ কাকে বলে পঙ্কজ জানিয়ে দিলেন।
    পঙ্কজ মেয়ের বিয়ে দিলেন। অনেক খরচও হয়ে গেল। নগদ টাকা যৌতুক তো দিলেনই সাথে গহনা। আজিমের চোখ যেন কুত্তার চোখের মত হয়ে যাচ্ছে। বড় ভাই জোবের ভালো মন্দ কোন কথা বলেন না। স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার সময় বোন, দু-ভাইকে সালাম করতেই আজিম পা সরিয়ে নিল। জোবের বোনের মাথায় হাত রেখে দোয়া করল। পরের দিন পঙ্কজ আজিমকে বললেন, আজ এই মুহূর্তে আমি তোকে ত্যাজ্য পুত্র করলাম। আজিমের মনে সামান্য ভয়ের আভা নেই। সে বাপের খুব কাছে এসে বলল, "আমি কিন্তু পোলাডা তোমার, বুঝলে ? তুমি যেমন রাগ করে অন্য গ্রামের খেয়া ঘাট কিনে তা না চালিয়ে সেই গ্রামের মানুষদের বিপদে ফেলতে পারো, তাহলে তো আমিও কিছু পারি।
    পঙ্কজকে আজিম ধাক্কা দিয়ে ফেলে অর্ধ অচেতন করলেন। জোবের তখন বাড়িতে ছিলনা। কাছে গিয়ে আজিম বললেন, "কাউকে যদি ইহা বলো তবে কিন্তু দেহ ও মাথা আলাদা হবে।"  পঙ্কজ কোমরে একটু চোট পেয়েছেন। রাতে ঘুমাতে পারেন না। বউ বলে কি হল আবার ? সারাদিন তো ভালোই ছিলে। বউয়ের কথায় পঙ্কজ কাঁদতে থাকেন। আবার বউ বুঝার আগেই চোখ মুছে নেন। ভাবেন, ছেলে আমাকে যাই করুক তবুও আমার মেয়ে স্বামীর ঘরে ভালো থাকুক, সুখে থাুকক।
    পঙ্কজ যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন মেয়েটা বাপ মাকে দেখতে আসতো। একদিন হঠাৎ করেই পঙ্কজ মারা যান। মারা যায় নাকি মারা হয় তা সঠিকভাবে কেউ এখন জানতে পারেন নি। তবে বোনটা সত্যিকার ভাবে বিশ্বাস করে যে, আজিমই বাবাকে খুন করেছে। বাপের জন্য কি বোন বিচার চাইবে ? কে করবে বিচার ! কোনদিন হবে না, বরং তা প্রহসন ছাড়া কিছুই না।

    জোবের আজ মনে হয় ডাল খান নি। তবুও মাতালের মত চেয়ারে বসে আছেন। এদিক সেদিক হেলে পড়ছেন। উনি আবার কানে কানে কথা বলতে বেশী পছন্দ করেন। চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে লতাকে বললেন, " হোসেনের মা ? আজই তুমি জমসেরকে একটু ভালো করে বলো, যেন কালুকে নেওয়ার চেষ্টা করে।"  লতা চুপ, কোন কথা বলে না। আজিমের চোখদ্বয় কুকুরের চোখের মত হয়ে  যাচ্ছে। মনে হয় এখনই লতাকে খেয়ে ফেলবে। চেয়ার থেকে একবার উঠছেন একবার বসছেন। মনে হয় চেয়ারে বসে মজা পাচ্ছেন না। মাঝে মাঝেই উনির পাছায় ফোঁড়া হয়। উহা নাকি আজিমদের বংশগত ধারা। তবে জোবেরের হয় না। এই পর্যন্ত আজিম তিনবার বাড়িতেই মাইনর অপরেশন করিয়েছেন। এ কাজে বউই সহযোগিতা করেন। চেয়ারে বসলে ঠিক যেখানে ছোঁয়া লাগে সেখানে হয়। কি যে যন্ত্রনা ! তবে তা যেন আজিমের হয়েছিল না, হয়েছিল তাঁর বউয়ের। যন্ত্রনা যত তাঁর বউয়েরই ওপর দিয়ে যায়। রাতে উহ্‌ আহ্‌ ! বউ ধরে নিয়ে ছোট ঘরে বসিয়ে দেন। পনের দিন আগে একবার অপারেশন হয়েছেন পুরানো ব্লেড দিয়ে। বউ বলেছিল, একটা নতুন ব্লেড হলে ভালো হতো না ! আজিম বলেন, "রাখো তোমার নতুন ব্লেড, ধরো তারতাড়ি কাটা শুরু করো। এবার ভালো করে পুঁচ বের করো, আবার যদি হয় তবে কিন্তু খবর আছে।" বউ আগে আজিমকে অনেক ভয় পেলেও পরে শুনতে শুনতে ভয় কেটে গেছে। আজিম কথা বললে সাথে সাথেই বউ জবাব দেন, ’সেদিন তো বললামই আমি কাটতে পারবোনা, হাসপাতালে গিয়ে কেটে আসো। তাই আর হবে না।"

    আজিম লুঙ্গি পড়লে মনে হয় এই বুঝি খূঁলে যাবে। আজ তিনি বাম হাত দিয়ে নিজের লুঙ্গি গুছিয়ে শেষ বারের মত লতাকে বললেন, "দেখো বেটি এক মাস সময় দিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে কালুকে যদি জমসের বিদেশ না নেয় তবে তোর এই ঘর নিলামে বিক্রিয় করে কালুকে বিদেশ পাঠানো ব্যবস্থা করবো। কথাটা মনে থাকে যেন।"  আজিমের রাগ হলে কাকে কি বলেন ঠিক নেই। তুউ তোকারি অবিরাম বলতেই থাকেন। যাকে বলছেন সে যে কে তা যেন খেয়াল থাকেনা।
    হোসেনের চোখ রাগে বাঘের চোখের মত হয়ে যাচ্ছে। এক পা এগিয়ে আজিমের দিকে যেতে থাকে আবার পিছিয়ে আসে। হোসেন ঘরের দরজায় বাম হাত দিয়ে ধর দাঁড়িয়ে আছে। জোবের ঘরে গিয়ে একটা পাইপ ধরিয়ে আবারও বলছেন, "এই হোসেন তুই একটু তারাতাড়ি ভালো করে বলিস তো। কালু তো তোরই চাচাতো ভাই।" হোসের পাইপ টানে না কিংবা কাউকে পাইপ টানতে দেয় না। কিন্তু জোবেরকে কি বলবে !
    কসিম চলে যাচ্ছে। আজিমকে বলল, "কাকা ! আমার একটু কাজ আছে আমি যাই। কসিমের কথায় আজিমের কান খুঁলেনি। তিনি লতার দিতে তাঁকিয়ে আছেন। লতা ভাগিনা বউ, কি আর তাঁর করতে পারবেন। কামরুলের আজ বড় ক্ষতি গেল। সে বুঝেছিল কিছু মাল হাতে আসবে, কিন্তু তার কোন নমুনা পাওয়া যাচ্ছে না। যে ব্যাপারে আজকে তাঁকে ডেকেছে তাতে টাকার কারবার নেই। একটা পাইপ হলেও তো টানা যেতো। কামরুল হোসেনের মুখের দিকে তাঁকালো, ঠোঁটটা কালো কিনা, কালো হলে বুঝা যাবে পাইপ টানার অভ্যেস আছে। কিন' না, ঠোঁটটা লালগোলাপের মত লাল। পাইপ চেয়ে নিজের মানটা নিচে নামানো যাবে না। দেখি পান খায় কিনা? লাজ ফেলে হোসেনকে বলল, "এই হোসেন ঘরে কি পান আছে ? লতা গলা এগিয়ে দিয়ে বলল, পান টান খাই না।"  লতার ধমকানো কথায় কামরম্নল যেনে ভয় পেলো। কামরম্নল বলল, " ভাবি সালিস ডেকেছেন পান বিড়ি টিরি থাকবেনা তা কি হয় !" লতা বলল, ’নাহ্‌ থাকবে না। আমি কি সালিস ডেকেছি, যে ডেকেছেন তাঁর কাছ চেয়ে নিতে পারো !" 
    এতোক্ষণে কামরুল বুঝলো, লতা মহিলাটা কাউকে ভয় পায় না। ও মুখের ওপর যে সরাসরি কথা বলেতে পারে সে অবশ্যই সাহসী মহিলা। কিসের পান বিড়ি ! কামরুল আজিমের বসা চেয়ারের কাছে গিয়ে বলল, " চাচা চলেন তো। জমসের ভাই বিদেশ গিয়ে হয়তো সুবিদা করতে পারছেন না। তাই কালুকে ভিসা করে নিতে পারছেন না।"  আজিম আবারও চেয়ারে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, "ওরা চালাকি করছে, কালুকে বিদেশ নিবে না সেই ফন্দি করতেছে। না নিয়ে যাবি কই ! আমি আজিম বেঁচে থাকতে তা সহ্য করব না। ওর মায়ের জমিন বিক্রির করে ও একাই ভালো থাকবে ! আরেক ভাইকে জলে ভেসে এসেছে ?"  জোবের বললেন, " দেখ আজিম এত চেচামেচি করিস না,। আমি বলে দিয়েছি এবার কাজ হয়ে যাবে, বাড়ি চল।" কামরুল, জোবের ইয়ামিন ও মুফিত সবাই আজিমকে বাড়ির দিকে নিয়ে গেলেন।
    ইয়ামিন এ বাড়ির ভাইদের মধ্যে সবার বড়। তাঁকে সবাই গ্রামের সালিসে ডাকেন কিন' তিনি কোন সালিসে দুটো ভালো মন্দ কথা বলেছেন এমন কারো জানা নেই। যে কোন সালিশে যাবেন প্রথমেই, গিয়ে ভালো একটা চেয়ারে গিয়ে বসবেন, আর নিজের হাতে ও পায়ের মরা চামরাগুলো খুচিয়ে খুচিয়ে তুলতে থাকেন। উপস্থিত মাতাব্বররা সবাই কথা বললেও তিনি নীরব। কথা বলতে বললে তিনি বলবেন, "তোমরা যা বলেছো তাই তো ঠিক আমি আর কি বলব ?"
    ইয়ামিনের দুই ছেলে, হাবলু ও আবুল। হাবলু বড়। সে অনেক দিন ধরে বিদেশ থাকছে, এখনও আছে। হাবলুর বড় গুণ সে তাঁর বাবাকে বাবা বলে ডাকতে লজ্জা পায়। তাই বলে না। ছোট বেলায় ইয়ামিন যখন মাঠের জমি চাষ করতে যেতেন। তখন হাবলূ বাপের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে যেতো। হাবলু পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। তবুও বলতো না, ’বাবা ! তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি, খেয়ে তারপর কাজ করো।’ অনেকক্ষণ বাপের পিছনে ডিস ও পানির জগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও যখন দেখে বাপ পেছনে তাঁকাচ্ছেনা। তখন শুধু শুধু উছিলার জন্য ডানে কিংবা বামে তাঁকিয়ে কাউকে ডাকে। তখন ইয়ামিন বুঝতে পারেন, হাবলূ খাবার নিয়ে এসেছে। বলেন, "হাবলু এসেছিস ? দে তারাতাড়ি খেয়ে নেই, ক্ষুধায় পেটটা চোঁ চোঁ করছে। তা এতো দেরি করে এলি কেন ? তোর মা ভাত রাধতে দেরি করেছে ?" হাবলু বলে, "এতো প্রশ্ন করছো কেন ? তারাতাড়ি খাও। আমি এখনও খাইনি, তোমার খাওয়া শেষ হলে থালা জগ নিয়ে বাড়িতে গিয়ে খাবো।" ছেলের কথা শুনে ইয়ামিন হা করে কিছুক্ষণ খাওয়া বাদ রেখে তাঁকিয়ে থাকেন। সৃর্য পশ্চিমে হেলে গেছে, সেই আলো ইয়ামিনের মুখে গিয়ে তাঁর মুখের ভিতরের সব দেখা যাচ্ছে। হাবলু সব কিছু নিয়ে বাড়ি চলে যায়। ইয়ামিন আবার নিজের কাজে মন দেন। 




    পূবহাটি গ্রামটা জমসের ও শামুদের নানার বাড়ি, বাপের আসল বাড়ি নয়। তাই তাঁরা এই বংশের নয়। এই জন্য সুযোগ পেলেই এই আজিম ও তার ভাইয়েরা এবং তার সন্তানরা পর মানুষ বলে গাল দেয়। সেই গাল এখন হোসেন হাসেম কালু নাহার ও শিখার ওপর গিয়ে পড়ে। কি আর করা ! ভূলটা তো শোধরানো যাবে না। হোসেনের মাথাও অমন কথায় মাঝে খারাপ হয়ে যায়। 
    মেয়েদের একটা অভ্যোস, তারা কোন ঝগড়া করলে সেই রেশ তারাতাড়ি তাদের মাঝ থেকে শেষ হয়ে যায় না। অনেকক্ষণ তা নিয়ে নিজের সাথে বক বক করতে থাকে। লতা অবশ্য তেমন মহিলা না হলেও আজ যেন তা পেয়ে ধরেছেন। বলছেন, " এখন নিজেরা না পেয়ে অন্য বাড়ির মানুষ ডেকে আমাদের অপমান করছে। এসেছিল বাপেরা, কি করে গেল ! কিছুই করতে পারবে না।"
    জমসের ও শামুর বাড়ি একই উঠোনের দুটো অংশে বিভক্ত। তিন ভাইয়ের মধ্যে ছোট ভাই মনু অনেক আগেই মারা গেছে। মনু নাকি অনেক চঞ্চল ছিল। সারাদিন এ বাড়ি সে বাড়ি টোঁ টোঁ করে ঘুরে বেড়াতো। সুযোগ পেলে অন্যের বাড়ির মাঁচা থেকে এটা সেটা তোলে খেতো। কখনও শসা কখনও গাছ থেকে পেঁপে পেয়ে খেতো। দিনের বেলায় কারো বাড়িতে গিয়ে বলতো, "চাচি ! তোমাদের গাছের নারিকেল বুঝি খুব মজা ! তা ঘরে পারা আছে নাকি ! খেতে খুব ইচ্ছে করছে। দাও না চাচি একটা নারিকেল।"  চাচি যদি বলেন ঘরে নেই, আর গাছে যে ক’টা আছে তা আমার মেয়ের বাড়ি দিতে হবে। তোকে দিতে পারব না, এখন যা। মনু আবারও বলবে দাও চাচি ! মনটা ঐ নারিকেলের ভিতরে চলে গেছে। শেষবারে চাচির মন খারাপ দেখলে মনু আর কিছু না বলে উঠে যাবে। পরের দিন সকালে বাড়িওয়ালা দেখবে গাছে একটা নারিকেলও নেই, নারিকেল যেখানে ঝুলে থাকে তাও নেই। দেখে মনে হবে গাছে কোন নারিকেলই ধরেনি। মনু নারিকেল চুরি করেছে তার কোন প্রমাণ নেই। গ্রামে সালিস বসে, মনুকে দোষি করে। সালিস ঠিকই হল কিন' মনুর বিরম্নদ্ধে কোন দোষ প্রমাণিত হল না।
    মনু তিন ক্লাস পর্যনত্ম পড়েছিল। তারপর আর পড়া হয়নি। ওর বড় ভাই জমসের। সে তো মনুকে প্রায়ই মারে। নারিকেল চুরির দায় যখন মনুর ওপর পড়লো, তখন তো জমসের তাকে মারবে না কাটবে ভেবে পান না। বাঁশ ঝার থেকে কাঁচা কঞ্চি এনে মনুকে সেকি মার মারলো। ওর মা ঘরে বসে শুধু কেঁদেছিল। সারা পিঠ জখমে ভরে গেছে। মনু শুয়ে আছে নিজের ঘরে। পাশেই ওর মা বসে গামছা দিয়ে আগুনের ছেক দিচ্ছেন। জমসের ঘরে যেতেই মনু মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইলো। ওর মা বলেন, "কোন মানুষ কি তার নিজের ভাইকে এমন ভাবে মারতে পারে ?" কেঁদে মনুর মা বের হয়ে গেলেন। জমসের বিছানার কাছে গিয়ে মনুর পিঠে হাত দিয়ে বলল, "খুব লেগেছে রে ? বিশ্বাস কর তোকে মারতে চাইনি। যখন শুনলাম তোর ওপর চুরির অভিযোগ পড়েছে তখন মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। তুই কেন নারিকেল চুরি করতে গেলি ?"
    -খেতে মন চাইলো তাই। তাছাড়া আমি চুরি করার আগে চাচির কাছে গিয়ে চেয়েছিলাম, দেন নি। আমার তো আমার জিদ, চাওয়া জিনিস না পেলে মাথা ঠিক থাকেনা।
    - চুরি করেছিস প্রমাণ হলে তো সালিসে তোকে মারতো। আমি তা সইতে পারতাম না, তাই আমিই মেরেছি যাতে তাঁরা আর না মারতে পারেন। এখন বল ! ঠিক করেছি কিনা?’ জমসের ও মনু উভয়কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। এতো মার খাওয়ার পরও মনুর মনে রাগ থাকেনি। মনু বরঁশি দিয়ে মাছ ধরতো। মাছ না ধরলে বরঁশিতে চিংড়ি কিংবা কেঁচো দিয়ে তা কারো উঠোনে দিতো। বাড়ির মোরগ, মুরগি তা খেতো। মনু খুশিতে নাঁচতে থাকতো। জোর করে ধরে সেই বরঁশি মোরগের মুখ থেকে টেনে বের করতো। ততক্ষণে মোরগের অবস'া কাহিল, মানে মরে গেছে। এ নিয়ে আবারও জমসেরের হাতে মার খায়। ছোট ভাইকে আর কত মারা যায় ! গালে কিংবা পিঠে আঘাত করলে তা যেন নিজের শরীরেই এসে পড়ে। মাকে গিয়ে বলে, " মা তোমার ছেলে কে একটু থামাও। অন্য বাড়ির মানুষ ওর জ্বালা আর কত সইবে ? প্রতি দিন কোন না কোন কান্ড করেই যাচ্ছে।"
    ভাই কিংবা মায়ের গালাগাল মনুর মনে বেশীক্ষণ থাকে না। আবার চলে তার নিত্যদিনের কাজ। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবে আগামী কালের ভাবনা। মনুর চোখে যেন গ্রামের সব কিছু ভেসে উঠে। ভাবে, মুফিত মামার মেয়ে খাদি দেখতে মন্দ না। কিন্তু খাটো ও কালো। খাটো মেয়ে তো আমার পছন্দ হয়না না। তবে ওর কথা বলার ভঙ্গিমা ভালো। চোখের পানে তাঁকালে শরীরের পশমে পশমে টক্কর হয়। মনুর ভাবনা খাদিকে নিয়ে গভীর হতে থাকে। রাত গভীর হতে থাকে। মনু যেন খাদিকে নিয়ে একটা বট গাছের চড়ে বসে আছেন। তার হাতটা মনুর হাতে। বলছে, এই খাদি ! তোমার সাথে কি আমার বিয়ে হবে ? বিয়ে হলে তোমাকে আমি পুঁটি মাছের ভাঁজি খাওয়াবো। আমি পুঁটি মাছ ভালো করে ধরতে পারি। শিং মাছ ধরতে গেলে ব্যাথার ভয় করে। খাদি বলে আমি তো শিং মাছই বেশী পছন্দ করি, পুঁটি না। মনুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। বলে, ঠিক আছে এখন থেকে ধরার চেষ্টা করবো। যদি তার কাটা বিধে দেয় তুমি কিন্তু তোমার মুখ দিয়ে চোষে ব্যাথা দুর করে দিও। আর তোমার আমার বিয়ের কথাটা কি তোমার মা নাকি বাবাকে বলতে হবে ?
    -বাবাকে বলো, বাবা যে ঘরে থাকে সেখানে কিন্তু বড় একটা বাঁশের লাঠি আছে জানো ?
    -লাঁঠির কথা এখন কেন ? সেটা দিয়ে তো বিড়াল তাড়ায়, তাই না ?
    -মানুষও তাড়ায় মাঝে মাঝে। মনুর মনে ভয়ের ভাব হয়। তুমি কালই বাবাকে বিয়ের কথাটা বলো, বাবা যদি ঘরে থাকে তবে লাঁঠিটার খোঁজ আগে নিয়ে কথাটা বলো কিন্তু। তোমার কি কাথা ধোয়ার অভ্যোস আছে ?
    -কাথা মানে ?
    -আমি প্রতি রাতেই বিছানায় পেচ্ছাব করি। বিয়ের আগে মা ধুয়ে দিচ্ছেন। বিয়ের পর তো তোমাকেই ধুতে হবে, তাই না ? রাজি কিনা, থাকলে বলো ? কিছু দিন আগে আবার এক বিয়ে এসেছিল, মা তাদেরকেও এমন কথা বলেছেন। তাঁরা এর কোন জবাব না দিয়ে চলে যান। পরে বুঝতে পারলাম তাঁরা রাজি না।
    -শুধু পেচ্ছাবই করো নাকি সাথে হাগুও ?
    -এখনও করিনি তবে বিয়ের পরে কি হবে বলা যায় না।
    মনুর নাকে যেন গুয়ের গন্ধ এসেছে। সে হাত দিয়ে নাক চেপে ধরেছে। বলল, ’বিয়ার গুষ্টি কিলাই। এমন মেয়ের কথা তো জীবনেও শুনিনি। এক্ষুণি গাছ থেকে নেমে পড়। গাছটা অপবিত্র হয়ে গেছে।’
    -গাছটা কি তোমার বাপের ? মনু কিছু না বুঝতেই খাদি মনুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। মনু চিৎকার করে বিছানা থেকে উঠে বসলো।

                                                                         
                                                                                                                                                          চলবে

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

[blogger]

sislam8405

{Facebook#https://www.facebook.com}

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget