পরিচয় । Porichoy । The Introduction । বাংলা গল্প


    গত তিন দিন ধরে বশির স্কুলে যায় না। আমেনা বেগমও ওকে স্কুলে যেতে তাগিদ দেন না। বশির উঁচু টিবির ওপর একা বসে কী যেন ভাবছে। ওখানে সে প্রায়ই বসে থাকে। আমেনা বেগম সকাল থেকে বশিরকে খুঁজছে। না খেয়ে ছেলেটা কোথায় গেল ! বশির মা মা ডাক দিয়ে এসে বলল, খেতে দাও খুব ক্ষুধা পেয়েছে। বশির খাবার খাচ্ছে ও বলছে, জানো মা আজ আমার মনটা খুব ভাল লাগছে। তোমার মুখ পানে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, কত যেন মায়া ওতে লেগে আছে। 
তোর মুখে এই সব কথা আগে তো কভু শুনিনি। আজ কি হয়েছে রে তোর?
একটু আগে একজন বুড়ো মহিলার সাথে দেখা ও কথা হল, তিনি আমাকে ইংগিত করে বললেন। আমার ছেলে যদি থাকতো তাহলে তোমার মত এত বড় হতো, আমাকে ভিক্ষা করতে দিত না। আমি বললাম সে কোথায় থাকে? তিনি বললেন হারিয়ে গেছে, জানি না কোথায় আছে। কত পথ প্রান্তরে খোঁজা খুঁজি করেছি পাইনি তবে মনে বিশ্বাস আছে বাজানরে আমার বুকে ফিরে পাবো। আমি বললাম, আপনার ছেলেকে এতো দিনে দেখলে চিনবেন? তিনি বললেন, চিনবোনা মানে সে তো তোমার মত।
আমেনা বেগমের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বশির না দেখার আগেই তা নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে নিলেন। বাবলু বাড়িতে নেই। আজ বাড়ি ফিরবে। তার এক বন্ধুর বিয়েতে গেছে। বশিরকে যেতে বলেছিল, যায় নি। বশির খাওয়া শেষ করে তার নিজের ঘরে চলে গেল। আমেনা বেগম আর খেতে পারলেন না। বুকটা কেমন যেন করছে ! মায়ের মনে সন্দেহ, ছেলেকে হারানোর ভয় জেগেছে।
আমেনা বেগম জানেন বশির তার পেটে ধরা সন্তান নয়, নিজের সন্তান না হলেও এতোটুকু অবহেলা কিংবা বকাঝকা করেননি বশিরকে, যেটুকু বাবলুকে করেছেন।
আমেনা বেগমের মনে শান্তি নেই। তাঁর ভাবনা শুধু বশিরকে নিয়ে, ও যদি জানতে চায় যে, সে নিজে দুই বছর আগে কোথায় ছিল ! তখন উত্তর দিব ! তিনি নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করলেন তাতে কোন সমাধান খুঁজে পেলেন না। শুধু বুকটা হাহাকার করছে। বশিরকে পেটে ধরা ছাড়া আর কী করিনি ! খাওয়ার পর নিজের আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিয়েছি, কোন অসুখ হলে সারারাত জেগে সেবা করেছি, এই বলে আমেনা বেগম আত্মনাদ করছেন। গত দুই বছরের সব স্মৃতি আমেনা বেগমকে তাড়া করছে।
পাশের ঘর থেকে বশির এসে বলল, মা একটা কথা বলব?
আমেনা বেগমের বুকটা নাড়া দিয়ে উঠলো। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে জানতে চাইলেন কি বলবি বাবা বল?
মা তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা তিনজন একত্রে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যেতে চাই। শুনেছি জায়গাটা খুব সুন্দর। সাগরের ঢেউ, সূর্য ডুবার দৃশ্য, জোয়ার ভাটা আর কত কী !
ঠিক আছে তাহলে আমরা আগামীকাল রাত দশটার ট্রেনে রওনা হবো।
বাবলু তো খুশিতে আত্মহারা, এই প্রথম সমুদ্রের ঢেউ দেখবে, শামুকের মালা, লোনা পানি ইত্যাদি। আমেনা বেগমের যাওয়ার তেমন কোন ইচ্ছা ছিল না, তবুও বশির যেহেতু ইচ্ছা প্রকাশ করেছে সেই কারণে যাওয়া।
শীতকাল। কাপড় চোপর নিয়ে রাত দশটার ট্রেনে রওনা হল। হিম বায়ুতে ট্রেন ঝনঝন শব্দে চলছে। বশিরের এই সময় কার কথা যেন মনে পড়ছে। কে যেন অনেক বার সমুদ্র সৈকত দেখতে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। তার নামটা মনে আসছেনা। আজ বশির যাচ্ছে হয়তো ভাল লাগবে না কিংবা লাগতেও পারে ! বিভিন্ন্ন কথা বশিরকে জড়িয়ে ধরলো।
ট্রেন স্টেশনে থেমেছে। ওরা তিনজন ট্রেন থেকে নেমে এক হোটেলে উঠলো। সকালের নান্তা শেষ করে বশিররা সমুদ্র তীরে গেল। কত হাজারে হাজার মানুষ এসেছে সমুদ্র তীরে তাদের আপন কাছের মানুষকে নিয়ে। কিন্তু বশির একাকি দাঁড়িয়ে ঢেউগুলোর দিকে তাঁকিয়ে আছে। যদিও ওর মা ও ভাই সাথে এসেছে তবুও ভালো লাগছেনা।
বশিরের মন আজ ঢেউগুলোর সাথে মিশে যেতে চায় দূর মহনায়, যেখানে শুধু প্রেমের বন্দর, নেই রিক্ততা, কোন হতাশা। কোন বিরহের সুর নেই। বশির একটি বড় পাথরের ওপর বসে আছে। হঠাৎ ভাবনায় একটি কবিতা লিখে ফেললো সমুদ্রের ঢেউকে উদ্দেশ্য করে---
ঢেউ তুমি ঢেউয়ের মত
                       আমার মত নও  তো,
 আমার মত আমার প্রিয়া 
                                                                              তুমি তা জানো তো ।
দুপুরের খাবার শেষ করে আবার সমুদ্রের ঢেউ দেখতে গেল ওরা। তারপর হিমছড়ি চললো। ঝরনার পাড়ে দাঁড়িয়ে বশির এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে তার কলকল শব্দ শুনতে পেল।
সন্ধার আগে ওরা তিনজন হোটেলে ফিরলো। রাত নয়টার ট্রেনে ফিরতে হবে। যে সার্ট ও প্যান্ট পড়ে জলে নেমেছিল তা লোনায় দাগ হয়ে গেছে। সার্টের পকেটে লবন ভরে গেছে। কিছু হালকা খাবার খেয়ে নিল তিন জন। এই সমুদ্র সৈকত বিদায় দিয়ে বশিরের কিছুতেই যেতে মন চাইছে না। এই সৈকতের মাঝে বশির একজনকে খুঁজে পেয়েছিল অদৃশ্য আবেশে। কিছুটা সুখের পরশ উঁকি দিয়েছিল। এই সামান্য সময় বশিরের হৃদয়ে গাঁথা থাকবে।
জানালা বেয়ে বাহিরের দিকে তাঁকিয়ে আছে বশির। মনে হয় গাছপালা বাড়িঘর সব পিছনে পালিয়ে যাচ্ছে। বশিরের মনকে তা দোলা দিচ্ছে। আমেনা বেগম, বাবলু ও বশির একই লাইনের সিটে বসে আছে। এগারোটার দিকে বাবলু ও মা ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু বশিরের চোখে ঘুম আসছে না। তার চোখে শুধু সমুদ্র সৈকতের ঢেউগুলো ভাসছে আর তার কথা মনে পড়ছে। বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বশিরও ঘুমিয়ে  পড়ে। 
ট্রেন কুমিল্লার কাছাকাছি। পাঁচ ছয়জন মুখোশধারি লোক বশির ও বাবলুর বুকে পিস্তল ধরে বলল, টাকা পয়সা সোনা দানা কাপড় চোপড়  যা আছে সব দিয়ে দে নয়তো ফুটা করে দিব।
আমেনা বেগম ডাকাতদের পায়ে ধরে বলেন, দয়া করে আমাদের যা কিছু আছে সব নিয়ে যান তবুও আমার বাজানদের মারবেন না। বশির ডাকাতদের সাথে একটু জোর করায় মাথায় একটু আঘাত লাগে তাতে ও অজ্ঞান হয়ে যায় । সামনের স্টেশনে ট্রেন থামলো বশিরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। এত রাতে কী আর রোগী ভর্তি করা যায় ! তবু অনুরুধ করে ভর্তি করা হল। সেদিন আর বাসায় ফেরা হল না। রক্তে বশিরের দেহ ভিজে গেছে। ডাক্তার বললেন, মাথায় আঘাতটা একটু বেশী লেগেছে ব্রেনের ওপর চাপ পড়েছে, বলা যায় না কী হবে। আল্লাহকে ডাকেন।
এই অচেনা এলাকায় বাবলু ও আমেনা বেগম অন্থির হয়ে পড়লেন, কোন চেনা জানা নেই। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ বশির চোখ খুঁললো কিন্তু কোন কথা বলছে না। শুধু মা আমেনা বেগম ও বাবলুর দিকে তাঁকিয়ে আছে।
বশির বিছানায় শুয়ে আছে, আমেনা বেগম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কেমন লাগছে? গতকাল রাতে ট্রেনে আমাদের ওপর ডাকাতরা আক্রমণ করেছিল তখন তুই মাথায় আঘাত পেয়েছিলি আর এই হাসপাতালে এনেছি।
আমি কেন ট্রেনে যাবো, আমি তো আপনাদের চিনি না। আপনারা কে? আমার নন্দিনি কোথায় যাকে নিয়ে আমি পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যাই।
আমেনা বেগম অবাক হয়ে বশিরের পানে তাঁকিয়ে রইলেন। বললেন, বাবা বশির আমি তোর মা আর বাবলু তোর ছোট ভাই। আমাদেরকে চিনতে পারছিস না?
কি আবোল তাবোল কথা বলছেন। আপনারা কেন আমার মা ও ভাই হবেন? আমার মায়ের নাম মনিকা বাপের নাম করিম শেখ আর আমার একমাত্র বোন চাপা।
 আমেনা বেগম ডাক্তারকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন, একি হয়ে গেল, আমার ছেলে আমাকে চিনতে পারছে না। বাবলুকেও অস্বীকার করছে।
ডাক্তার বললেন; একটি সত্যি কথার উত্তর দিন। বশির কি আপনার পেটে ধরা সন্তান নাকি পালিত সন্তান?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমেনা বেগম বলেন, বশির আমার পেটে ধরা সন্তান না হলেও নিজের সন্তানের মত স্নেহ মমতা দিয়ে বুকের মাঝে আগলে রেখেছি। কখনও বুঝতে দেইনি দুঃখ কষ্ট কাকে বলে। আর সেই সন্তান যদি আমাকে অস্বীকার করে তাহলে কেমনে বাঁচবো, বলেন ডাক্তার সাহেব?
ওদিকে বশির বলছে, আমি বাবা মার কাছে যাবো, আপনাদের সাথে যাবো না। আমেনা বেগম কাছে গিয়ে বললেন, আগে আমাদের বাসায় চলো তারপর ঠিকানা জেনে তোমাকে তোমার বাবা মা’র কাছে পৌচ্ছে দিব।
ওরা তিনজন গাড়ি চড়ে প্রায় বিকাল চারটার সময় বাসায় ফিরলো। আমেনা বেগমের মনে কোন শান্তি নেই শুধু ফুপিয়ে কাঁদছেন কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেন না। বশিরকে তার ঘরে নিয়ে বললেন, মনে করে দেখো তো বশির এই ঘরে তুমি থাকতে গান গাইতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। এসব মনে করার চেষ্টা করো !
অন্য কী ঘটেছে আমি জানি না, শুধু আমার চোখের সামনে ভাসছে মা বাবা আমাকে ডেকে বলছেন, ওরে খোকা আমার বুকে আয়। এক মাত্র বোন চাপা, তার মুখ থেকে কতদিন যেন ভাইয়া ডাক শুনিনা। আমি তাদের কাছে যাবো আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন। আচ্ছা আপনাদের সংসারে আমার আগমন কতদিন ধরে?
মা আমেনা বেগম একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল। গত দুই বৎসর যাবৎ তুমি আমাদের সাথে আছ। এর মাঝে কোনদিন তোমার বাবা মা বোনের কথা তুমি বলোনি। তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও তুমি তখন বলতে পারোনি, শুধু কেঁদেছো। আমার ইচ্ছায় তোমায় আমার সন্তানের মত লালন পালন করেছি।  তারপর তোমাকে ক্লাস নাইনে ভর্তি করে দিলাম এ বছর তুমি ক্লাস টেনে।
আমি তো এস এস সি পাস করেছি। যাক- আমাকে যেহেতু আপনি ছেলের মত আদর দিয়ে স্নেহ দিয়ে বুকে ধরে রেখেছেন, সেহেতু আপনি আমার মা। মা আমাকে বলুন, আমাকে কিভাবে খুঁজে পেলেন?
সেদিন আমি আমার এক মাত্র সন্তান বাবলুকে নিয়ে আমার এক আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলাম। প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। চারদিকে অন্ধকার, আকাশটা মেঘে ভরা, মেঘের গর্জন মাটি কাঁপিয়ে তুলছিল। তবুও পথ দিয়ে হাঁটছি। হাতে ছিল টর্চ লাইট। হঠাৎ কাছেই পথের ধারে একটা মানুষ পড়ে থাকতে দেখি। রক্ত মাখা মুখ, রক্তে সারা শরীর ভিজে গেছে। মাথায় ক্ষত দাগের চিহ্ন। কনকনে শীতে কাঁপছে। আমি আর বাবলু তাকে তাড়াতাড়ি তুলে মূল পথে নিয়ে এলাম। অনেক কষ্টে একটা ভ্যানে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বললেন, অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে, রক্ত দিতে হবে। ভাগ্য গুণে ঐ হাসপাতালে রক্ত পেয়ে গেলাম। পরের দিন সকাল দশটায় ছেলেটির জ্ঞান ফিরলো। আর আত্মীয় বাড়িতে যাওয়া হল না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম তোমার নাম কি? তোমার বাড়ি কোথায়? কে কে আছে তোমার?
কোন উত্তরই দিতে পারল না। শুধু কাঁদতে থাকে। আর সেই থেকে তাকে আমাদের মাঝে রেখে দিলাম। তুমিই হলে সেই বশির। আর কখনও জানতে চাইনি তোমার পরিচয়। নিজের সন্তান বাবলুর সাথে তোমাকেও আদর স্নেহ ভালবাসা দিয়ে বুকে আগলে রেখেছি। কখনও বুঝতে দেইনি তুমি আমার সন্তান না। আজ আমার বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে কেমনে তোমাকে বিদায় দিব? আচ্ছা বশির তোর পুরানো জীবন সম্পর্কে সব মনে আছে?
জি সব মনে আছে। আপনাকে সব বলব যদি শুনতে চান।
তাহলে বল..
                                                               সমাপ্ত                                     
কবি ও কবিতা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

[blogger]

sislam8405

{Facebook#https://www.facebook.com}

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

luoman থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget