সংকটকাল ।। Sangkatkal ।। বাংলা উপন্যাস ।। Bangla Novel ।। প্রথম পার্ট
(প্রথম পর্ব )
দক্ষিণ দিকে গ্রামের সকল আবাদি জমি। দীর্ঘ একটা খাল চলে গেছে দক্ষিণ-পশ্চিম হতে উত্তর-পূর্ব বরাবর। খালে বর্ষার সময় অনেক জল থাকলেও অন্য সময় টাকনু কিংবা হাঁটুর ওপরে গড়ে না। খালের পাড়ে বসে থাকলে অনেক লোকের পারাপার দেখা যায়। কাছে ও দূরের অনেক পরিচিত অপরিচিত লোকের চলাচল হয়। কি এক সবুজ শ্যামল সভ্যতার দুরন্ত রুপ !
ছোট ছেলে মেয়েরা খালে একসাথে কিংবা আলাদা ভাবে বিভিন্ন পদ্ধতিতে মাছ ধরে। ওরা আর কি মাছ ধরবে
! দুটো পুঁটি টেংরা শিং এবং চিংড়ি ধরতে পারলেই তা মায়ের কাছে দৌড়ে নিয়ে যায়। টেংরা ও শিং ধরা অবশ্য সহজ নয়
! ধরতে গেলই নিজেকে রক্ষা করতে ওরা কাঁটা বিঁধে দেয়। আর তা সে কী ব্যাথা
! ব্যাথা তেমন বেশী সময় থাকে না,
পাঁচ থেকে দশ মিনিট পর কমে যায়। ওসব আমলে নিলে কী আর মাছ ধরার মজায় নিজেকে জড়ানো যায়
! গায়ে কাদা মাখানো অবস্থায় মায়ের কাছ গিয়ে বলে, মা
দেখো কত মাছ ধরেছি। মা হেসে বলেন, ঐ দু-পুঁটি দিয়ে কী
তরকারি রান্না হবে?
মায়ের কথা শুনে সন্তান আবার দৌড়ে খালের ধারে যায়। কিসের মাছ,
এ যেন এক অসীম আনন্দ খেলায় মজে থাকা।
আঁকা বাঁকা হয়ে যাওয়া খালের দীর্ঘতা খুব বেশী নয়। খালের যে অংশটুকু যার জমিনের পাশে পড়েছে সেখানে তারা গাছের বিভিন্ন ঢাল ফেলে রাখে যাতে করে ওখানে মাছ আবাসন করতে পারে। পরে চারদিকে জাল ফেলে কিংবা জল কিছু কমলে বেড়া দিয়ে মাছ ধরে।
ফাহিমের মাছ ধরা একটা বড় শখ। সে মাছ ধরতে গিয়ে না পেলেও কষ্ট নেয় না। দিন শেষে যদি দুটো টাকির পোনা কিংবা চিংড়ি পায় তা আর বাড়িতে না নিয়ে পাশের কোন পুকুরে ছেড়ে দেয়। বাড়িতে গিয়ে মায়ের বকুনিতে তার মনে কোন দাগ কাটে না। কাদা ভরা হাফ প্যান্টখানি খুঁলে সাবান নিয়ে পুকুরে নেমে পড়ে। যদি অন্য সময় মায়ের বকুনির কারণে সাবান আনতে না পারে তবে নিজের হাফপ্যান্ট খুঁলে তা দিয়ে নিজের শরীর ঘসতে থাকে। সাবান ছাড়া খালের আঠালো কালো কাদা উঠতে চায় না
! বরং তা আরও শক্ত ভাবে গায়ের সাথে লেগে থাকে। শরীর যখন শুকায় তখন কাদার ছাপ ছাপ অংশ ভেসে উঠে।
বাতাসি ফাহিমকে বলে,
আর যদি কোন দিন ঐ কাদায় নামিস তবে কিন্তু খবর আছে ! বাতাসির চোখের লালচে আভায় ফাহিমের মনে কোন রাগ হয় না। আরও ভেবে নেয়,
পরেরবার যদি বেশী মাছ পাই তবেই মায়ের লাল চোখ সাদা কালো মানে ভালো হয়ে যাবে। ফাহিমের ডান হাতের মধ্য আঙ্গুলে একটা ছোট টেংরা মাছ কাঁটা বিঁধে দিয়েছে। ইচ্ছা ছিল মাকে বলবে। কিন্তু মায়ের রাগারাগিতে বলার সাহস হয়নি। যদিও মা মাছের কারণে রাগ করেনি,
করেছে গায়ে কাদা লাগানোর কারণে।
দক্ষিণমুখি ঘরটায় পুরানো টিনের চাল। টিন পুরানো হওয়ার একটা ধরণ আছে কিন্তু ফাহিমদের ঘরে চালের টিন বেশী পুরানো। মাঝে মাঝে একাই টিনের খন্ড খন্ড অংশ ঘরের মেঝেতে পড়ে। অনেক সময় খাবার থালায় টিনের মরিচা পড়া অংশ পাওয়া যায়। ফাহিম বলে, মা, এই টিনের খন্ড কোথা থেকে এলো?
বাতাসি বলে,
ইহা আবার নতুন কি
! ঐ ওপরে তাঁকিয়ে দেখ কত ছিদ্র। এখন তো কিছু না হয় ঢাকনা আছে। ক’দিন পর তাও থাকবেনা। খোঁলা আকাশের নিচে খেতে ও ঘুমাতে হবে।
ফাহিম মায়ের কথায় আর কিছু না বলে তাঁকিয়ে থাকে। একটু পরে বলে, মা ! আমরা এতো গরীব কেন?
আমাদের ঘর কবে সাদা টিনের হবে?
এই ঘরে থাকতে ভালো লাগেনা,
পড়তেও মন বসে না। রাতে পিঁপড়ায় কামড়ায়,
এই দেখো গত রাতে কতগুলো কামড় খেয়েছি।
ছেলের কথায় বাতাসির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। এর তো কোন জবাব নাই। অবুঝ ছেলেকে বাতাসি কী
বলে শান্তনা দিবে ! তবুও চোখের জল মুছে বলে,
তুই বাবা যখন বড় হয়ে চাকুরি করবি তখন আমাদের এই ঘর আর থাকবেনা,
রাতে কোন পিঁপড়ায়ও কামড়াবে না। এই মরিচা পড়া পুরানো টিনের চাল থাকবেনা।
চৈতি খুব ছোট নয়। বয়স বেধে হলেও দৈহিক ভাবে খুব ছোট নয় ফাহিমের। পড়ার জন্য ফাহিমের কোন চেয়ার টেবিল নেই। মাটিতে পলিথিন কিংবা পাটের বস্তা বিছিয়ে পড়ে। ওভাবে গড়িয়ে পড়লে বেশীক্ষণ পড়া যায় না। রাত হলে কিছুক্ষণ পড়লেই ঘুম ধরে। তাছাড়া পাটের বস্তার অমৃসণ আঁচড়ে হাঁটুর কিংবা কনুয়ে কালো দাগ পড়ে যায়। দেখা যায় ঐ স্থান অল্প দিনেই শক্ত হয়ে যায়। পিঠের দিকেও ব্যাথা হয়। তবুও ফাহিম ওভাবেই পড়ে। মাঝে মাঝে মাকে বলে,
দুটো চেয়ার টেবিল কিনে দিতে। বাতাসি বলে,
বিদ্যাসাগরের কাহিনী পড়েছো? সে কিন্তু
রাতের বেলায় পাশের বাড়ি কিংবা যেখানে আলোর ঝলক দেখা যেতো সেখানে গিয়ে বই খুঁলে পড়তো।
-উনি আবার কে মা,
সাগরের জলে থাকে?
-আরে না,
উনি বাঙলা সাহিত্যিক ছিলেন। খুবই গরীব বাপের সন্তান, কিন্তু মাথায় ছিল অগাধ জ্ঞান। অল্প পড়লেই সব বুঝতে পারতেন। সংসারের অভাবের কারণে কুপি জ্বালিয়ে রাতে পড়তে পারতেন না। কিন্তু পড়া কি তাই তার বাদ যাবে? তিনি বৃথাই যেতে দেননি। তোমাকেও তেমন কষ্ট করে পড়তে হবে। আমাদের তো চেয়ার টেবিল কেনার পয়সা নেই,
ঐ পলিথিনের কাগজে বসেই পড়তে হবে,
পারবেনা?
মায়ের এই করুন কথায় ফাহিম বলে, অবশ্যই পারবো, পারতে আমাকে হবেই।
গফুরের সম্পদ বলতে বাড়ি ভিটা ছাড়া আর কিছু নেই। ও এক সময় চালের কারবার করতো। তারপর মাঝে কিছুদিন কাঁচা মালের ব্যবসাও করতো। কাঁচা মালের ব্যবসায় যেমন লাভ থাকে, তেমনি সময় মত চালান করতে না পারলে মূল পুঁজি হারাতে হয়। নিজের কাঁধে বহন করে মালামাল আনা নেওয়া করা কষ্টকর
! অবশেষে গফুর ভাবলো,একটা সাইকেল কিনবো। কম দামে কিংবা পুরানো সাইকেল কিনতে হলেই অনেক টাকা লাগবে। সংসারে যেখানে নুঁন আনতে পানতা ফূরায় সেখানে অল্প টাকাও অনেক। কাঁচা মাল কেনার পর যাতায়াত খরচও অনেক দিতে হয়। দেখা যায় শেষে লাভ তেমন থাকেনা। যদি যাতায়াত খরচ কমে যেতো তবে লাভের মুখ বেশী হতো। নাহ্
! যে করেই হোক সাইকেল কিনতেই হবে। কথাটা বাতাসিকে বলবে গফুর ভাবল। ও যদি কিছু টাকা ওর স্যারের বাড়ি থেকে এনে দেয় তাহলে তো ভালোই হয়।
গফুর মিয়া যা ভাবে,
ভালো কিংবা মন্দ তা সে করবেই। যদি বিফল হয় তবে ঘরের সব আসবাব পত্র উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বিভিন্ন ধরনের গালাগাল দেয়। যেমন হারামির বাচ্চা,
শুয়রের বাচ্চা,
নটির জাত,
কুত্তার বাচ্চা ইত্যাদি। বাতাসি ভয়ে কিছু বলছে না। কিছু বললে যদি আবার ওকেও ধরে আসবাব পত্রের মত ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
হারামি মানে কী?
শুধু কথায় এমন একটা শব্দ শোনা যায়্। কিন্তু এ নামে তো তেমন কোন প্রাণিও নেই। শুয়র ও কুত্তা থাকলেও নটির বাচ্চা গফুর বাতাসিকে কিভাবে বলে?
বাতাসি তার ঘরের বউ। বউকে এমন গাল দেওয়া যায়?
অবশেষে বাতাসি গফুরের সাইকেল কেনার জন্য হক্কু স্যারের কাছ থেকে টাকা এনে দেয়। গফুর তার নিজের কাঁচামালের ব্যবসা ভালো ভাবেই চলতে থাকে। সংসারের সচ্ছলতাও বাড়তে থাকে। এভাবে অনেক সহযোগিতাই স্যার গফুরকে করে আসছে।
ফাহিমের বয়স তিন বছর হওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় এক পায়ে একটু আঘাত পায় গফুর। এখনও পূর্ণ ভালো হয়নি। বাতাসির প্রতিষ্ঠানিক কোনস শিক্ষা নেই। ভাইয়ের বই পড়া দেখে ও নিজে পড়ে একটু শিখেছিল। স্বামীর অভাবের সংসার ও নিজের হাতে ধরেছে। ভেবেছে,
যে করেই হোক দুই ছেলে মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করতেই হবে।
বাতাসির বাপের বংশ যেমন ভালো তেমনি সমাজের মাঝে নাম ডাক ছিল। ভাগ্যের কারণে সেই বাতাসির বিয়ে হয়েছে এক নিস্ব গরীব গফূরের সাথে। বাতাসির ইহা অবশ্য তৃতীয় বিয়ে। সে এক দীর্ঘ কাহিনী। বাপের সংসারে এক ভাবি ছাড়া এখন আর জানা মতে কেউ নেই। এখন তার সাথেও যোগাযোগ নেই। যেমন ছিল বাতাসির সেই কাহিনী......